সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা বাড়ছে। পূর্বশত্রুতা, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ ও সম্পর্কের টানাপড়েনের মতো ঘটনার জেরে এসব ঘটনা ঘটছে। এ ব্যাপারে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও গত আড়াই মাসে দেশে কুপিয়ে হত্যাকাণ্ডের অনন্ত ২০টি চাঞ্চল্যকর খবর গণমাধ্যমে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচারহীনতা ও জবাবদিহির চর্চা না থাকার কারণে কুপিয়ে হত্যার মতো নৃশংস অপরাধ বাড়ছে।
কুপিয়ে হত্যার সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে—গত ১৩ জানুয়ারি রাজধানীর খিলক্ষেতে জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে কাউসার দেওয়ান (৪৫) নামের এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা; ১৪ জানুয়ারি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নের কাউসার আলী লস্কর (৫০) নামের এক ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা; একই দিন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ভাংনাহাটি এলাকায় পোশাক কারখানার সৈকত মিয়া (১৯) নামের এক শ্রমিককে কুপিয়ে হত্যা। এ ছাড়া গত ৯ জানুয়ারি নেত্রকোনার দুর্গাপুরে চারজন দুর্বৃত্ত দেশীয় অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মো. শফিকুল ইসলাম (৪৮) নামের এক পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করে। সংশ্লিষ্ট এলাকার থানাগুলোর পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
এ ব্যপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বিচারহীনতা ও জবাবদিহির চর্চা না থাকার কারণে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের হার বাড়ছে।অপরাধ করে অপরাধীরা যখন পার পেয়ে যেতে থাকে, তখন তারা দ্বিগুণ উৎসাহে অপরাধ ঘটাতে থাকে। ক্রমে আরো নৃশংস হয়ে ওঠে। তারা মনে করে, এভাবে হত্যা করে তারাও পার পেয়ে যাবে। ফলে সহিংস ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেই চলেছে।এসব রোধে আইনের শাসন নিশ্চিত করাসহ সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মুনতাসীর মারুফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনে দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের মনো-সামাজিক বিশ্লেষণধর্মী গবেষণার অপ্রতুলতা রয়েছে। আমাদের দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে মানুষের হত্যা-প্রবণতার কারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়াবলি নির্ণয়ে এ ব্যাপারে নির্মোহ, পক্ষপাতহীন গবেষণা প্রয়োজন। কারণ অপরাধ সংঘটনে ও সহিংসতা বিস্তারে ব্যক্তির চেয়ে সমাজ বেশি দায়ী। যে সমাজে আগ্রাসনকে উৎসাহিত করা হয় বা যে সমাজ-রাষ্ট্রের রীতি-নীতি-আইন-প্রতিষ্ঠান অপরাধ সংঘটনে সহায়ক, সেখানে এ ধরনের প্রবণতা বেশি।
কুপিয়ে হত্যা করার মতো ঘটনার ব্যাখ্যায় মনো চিকিৎসকরা বলছেন, হতাশা থেকে একজন মানুষ মূলত আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। সেই হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সে বেছে নেয় দুর্বল একজনকে। এই দুর্বলের ওপর হিংস্রতা দেখিয়ে সে এক ধরনের মানসিক তৃপ্তি লাভ করে এবং হিংস্রতার সপক্ষে নিজস্ব যুক্তি তৈরি করে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘পুলিশ সব সময় জনগণের সেবাদানে তৎপর। যেকোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তত্ক্ষণাৎ তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তাসহ সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করে তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তবে এসব সহিংস অপরাধ রোধে পুলিশের পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির মিল না হলে প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে ওঠে। পাওয়া-না পাওয়ার দ্বন্দ্বেও মানুষ আগ্রাসী ও হিংস্র হয়ে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। তাই সামাজিক-পারিবারিক অস্থিরতা দূর করে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে রাষ্ট্র, সমাজ ও নাগরিকদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
নৃশংস হত্যার বিষয়ে অধ্যাপক ড. উমর ফারুক বলেন, বিভিন্ন কারণে মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে। ফলে ব্যক্তির বিরুদ্ধে সহিংস অপরাধও বেড়েছে। সম্পত্তিগত কারণ ও প্রযুক্তির কু-প্রভাবেও নৃশংসতা ছড়াচ্ছে। এ ছাড়া সুস্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো কমে গেলে সমাজে নৃশসংতা বাড়বেই। তাই সবার অবস্থান থেকে নজরদারি করতে হবে। একই সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে।