Image description

বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সবার উপরে অবস্থান করছে। ফলে খুবই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অবস্থান করছেন দেশের ১৭ কোটি মানুষ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন রাজধানী ঢাকার বাসিন্দারা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, পরিবেশগত কারণে প্রতি বছর ১৩ বিলিয়নেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে। জলবায়ু সংকট মানব স্বাস্থ্যের জন্যও বর্তমানে একক বৃহত্তম হুমকি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রামক ও অসংক্রামক সব ব্যাধির জন্যই বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী। এ কারণে মানসিক প্রশান্তি নষ্ট হচ্ছে, বাড়ছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। ফলে দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ বাসা বাঁধছে শরীরে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের ডেপুটি চিফ (এলপিআর) ডা. আব্দুল ওয়াদুদের মতে, বায়ুদূষণের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, বায়ুদূষণে ঢাকা শীর্ষে অবস্থানে চলে যাচ্ছে। তার মতে, বায়ুদূষণের সঙ্গে হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের একটা বড় সম্পর্ক রয়েছে।

ঢাকায় বায়ুদূষণের মাত্রাকে ভয়াবহ অস্বাস্থ্যর উল্লেখ করে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণের মান বর্তমানে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। এ মুহূর্তেই রেড এলার্ট তথা জরুরি অবস্থা জারি করা জরুরি। তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বায়ুতে দূষণের যে মাত্রা থাকার কথা তার চেয়েও ২০ গুণ বেশি রয়েছে। আর পরিবেশ অধিদপ্তর নির্ধারিত মাত্রার চেয়েও ৭-৮ গুণ বেশি। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে- কী কী কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে তা সবার জানা থাকলেও টেকসই কোনো উদ্যোগ নেই। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হলেও জনগণকেও অবহিত করা হচ্ছে না। ফলে বিষাক্ত বায়ু গ্রহণের মাধ্যমে মানুষ প্রতিনিয়ত জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও বর্তমান পরিস্থিতিকে খুবই নাজুক বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি এত দিনের সমন্বয়হীনতা আর অব্যবস্থাপনা দূরীকরণে দূষণ কমানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে এক সুতায় গেঁথে গঠন করেছেন টাস্কফোর্স।

বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান, ভারত, তাজিকিস্তান, বুরকিনা ফাসো, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নেপাল, মিসর ও কঙ্গো। এর মধ্যে বাংলাদেশ সবার শীর্ষে রয়েছে।

অন্যদিকে বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের ১২৫টি সিটির মধ্যে সপ্তাহের প্রায় দিনের কোনো না কোনো সময়ে সবার ওপরে ওঠে আসে ঢাকা। তবে বেশির ভাগ সময়েই ২ থেকে ৪-এর মধ্যে অবস্থান করে। এ দিক থেকে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় সবাইকে টপকে গেছে ঢাকা।

বুধবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকার আইএকিউএয়ারের স্কোর ছিল ২৪১। বৃহস্পতিবারও বিশ্বে বায়ু দূষণে শীর্ষে ছিল ঢাকা। দ্বিতীয় স্থানে ছিল কঙ্গোর রাজধানী কিনসাসা। বিশ্বের ১২৫টি নগরীর মধ্যে ঢাকার এ অবস্থান নির্ধারণ করেছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার।

এর মান সূচকে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে ঢাকায় বায়ুর মান ২৪২, এটিকে খুব অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরের মধ্যে চট্টগ্রামের বায়ুর মান ৯৩, রাজশাহীতে ১৬৭ আর খুলনায় ১৬৫ ছিল।

বায়ুদূষণের পরিস্থিতি নিয়মিত তুলে ধরে আসছে আইকিউ এয়ার। বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা এই লাইভ বা তাৎক্ষণিক সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে তথ্য দেয় ও সতর্ক করে। সেই সতর্কবার্তায় নগরবাসীকে আইকিউ এয়ারের পরামর্শ, বাইরে বের হলে সুস্বাস্থ্যের জন্য অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে।

আইএকিউএয়ারের এই সূচক অনুযায়ী, বায়ুকে খুবই অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

আইএকিউএয়ারের মানদণ্ড অনুযায়ী, স্কোর ৫১ থেকে ১০০ হলে তাকে মাঝারি বা গ্রহণযোগ্য মানের বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১০১ থেকে ১৫০ স্কোরকে ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ ধরা হয়। স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে তা অস্বাস্থ্যকর বায়ু। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে তাকে খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু ধরা হয়। ৩০১ থেকে তার ওপরের স্কোরকে ঝুঁকিপূর্ণ বা দুর্যোগপূর্ণ ধরা হয়।

ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে বায়ুদূষণজনিত সমস্যায় ভুগছে। এর বায়ুর গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে এবং বর্ষাকালে উন্নত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। বায়ুদূষণে প্রধানত স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যানসার ও শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ থেকে মৃত্যুর হার বাড়ে।

বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকেও ১৯৬ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ঢাকা। এ সময় সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থান মার্কিন দূতাবাস এলাকায় ২৫৯ স্কোরে উঠে আসে। আর ইস্টার্ন হাউজিং-২ এলাকায় ২১১, কল্যাণপুরে ২১০ এবং আইসিডিডিআরবি এলাকায় ২০৪। অন্যদিকে ঢাকার আশপাশের এলাকার মধ্যে সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ২৫১ স্কোরে উঠে আসে, যা সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থানে ছিল। বায়ুর এই মানকে খুবই অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ভৌগোলিকসহ নানা কারণে প্রতি বছর শীতের সময় ঢাকার বায়ুদূষণ বাড়লেও এবার শীতের শুরুতেই রাজধানীর বাতাসে দূষণের পরিমাণ বেড়ে গেছে এবং দূষণের দিক থেকে প্রায়ই প্রথম হচ্ছে। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইএকিউএয়ারের সূচকে গত এক মাসে ঢাকা একাধিকবার ৩০০-এর বেশি স্কোর নিয়ে সর্বোচ্চ দূষিতের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। অথচ কোনো স্থানের আইএকিউএয়ারের স্কোর যদি ৩০১ থেকে ৪০০ এর মধ্যে থাকে, তবে তা ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হওয়ার কথা। এমনকি, এই আইএকিউএয়ারের স্কোর যদি পরপর তিন ঘণ্টা ৩০০-এর বেশি থাকে, তবে সেখান স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থাও ঘোষণা করা যেতে পারে।

গত এক দশকের মধ্যে গড়ে এই বছরে ১০-১২ ভাগেরও বেশি বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা একটি বড় শঙ্কার বিষয়। আগের সব রেকর্ডকে ভেঙে বারবার দূষণের তালিকায় ঢাকার শীর্ষে চলে আসার পেছনে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণকে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে নির্মাণকাজ, বর্জ্য পোড়ানো, ঢাকার আশপাশে ইটভাটা, অতি পুরোনো যানবাহন চলা অন্যতম। ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য সিটি করপোরেশনকেও দুষছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ সড়কে নিয়মিত পানি ছিটায় না কর্তৃপক্ষ।

এদিকে বায়ুদূষণ বন্ধে সাত দিনের মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যবস্থা ও এর আগে দেওয়া ৯ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের এই আদেশ বাস্তবায়ন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ বিষয়ে আগামী ২৬ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।