
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতার চকচকে আইফোনের লোভ সামলাতে পারেনি ডিবি পুলিশ। শুনে অবাক হচ্ছেন? এটাই সত্য। গ্রেফতারের দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও প্রায় দুই লাখ টাকা দামের নতুন আইফোন ‘১৬ প্রো-ম্যাক্স’ জব্দ তালিকায় দেখানো হয়নি। নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। বিষয়টি অবশেষে আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। ডিবির অভিযুক্ত ওই কর্মকর্তাকে রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন একাধিক কর্মকর্তা। ফলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ফের সেই ‘ডিবি হারুন’র আমলে ফিরে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফ্যাসিস্ট আমলে ডিবি এক দানবে পরিণত হয়েছিল। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের তুলে এনে গুম করা, মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো, অভিযানের নামে টাকা, মোবাইল ও মূল্যবান জিনিসপত্র মেরে দেওয়া ছিল নিত্যদিনের বিষয়। রক্তক্ষয়ী জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পাওয়া নতুন বাংলাদেশের ডিবির এমন কর্মকাণ্ড অপ্রত্যাশিত বলে মনে করছেন অনেক পুলিশ কর্মকর্তা।
সূত্র বলছে, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের পক্ষে মিছিল করার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শেখ ইবনে সাবিতকে গত ৬ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এসময় তার কাছে ছিল প্রায় দুই লাখ টাকা দামের আইফোন ১৬ প্রো-ম্যাক্স। গ্রেফতারের তিন দিন আগে ওই ছাত্রনেতার কেনা চকচকে আইফোনটি নিজের পকেটে রেখে দিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর মো. আখতার মোর্শেদ। তিনি ডিএমপির ডিবি রমনা বিভাগে কর্মরত আছেন। এই কর্মকর্তা আরও অনেক আসামির ফোনসহ মূল্যবান জিনিস জব্দ তালিকার মাধ্যমে আদালতকে অবগত না করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
আইফোন ফেরত চেয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিট্রেট আদালতে একটি আবেদন করেছেন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতা শেখ ইবনে সাবিত। এদিকে ফোন আত্মসাতের বিষয়টি জানাজানি হলে গত রোববার থেকে গ্রেফতার ইবনে সাবিতের পরিবারকে নানা হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত ওই ইন্সপেক্টর ইবনে সাবিতের স্ত্রীকে একাধিকবার ফোন করে মোবাইল ফোন নিয়ে যেতে বলেছেন। কিন্তু পুলিশি হয়রানির ভয়ে পরিবারটি আত্মগোপনে চলে গেছে।
ইবনে সাবিতের এক সহকর্মী গণমাধ্যমে বলেছেন, স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের দিয়েও সাবিতের পরিবারকে শাসানো হচ্ছে। পুরো পরিবার আতঙ্কে দিন পার করছে।
অভিযোগের বিষয়ে ইন্সপেক্টর মো. আখতার মোর্শেদ যুগান্তরের কাছে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি প্রথমে বলেন, ‘ফোনটি আমার কাছে আছে। পরবর্তীতে তদন্তের জন্য রাখা হয়েছে।’ পরক্ষণেই বলেন, ‘আসামির পরিবার যোগাযোগ করলে দিয়ে দেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে ডিবি রমনা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার (ডিসি) মো. ইলিয়াস কবির ওই ইন্সপেক্টরের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। জব্দ তালিকার মাধ্যমে আদালতকে কেন অবগত করা হলো না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছু জিনিস আমরা ফ্যামিলিকে বুঝিয়ে দেই। আমাদের সঙ্গে ফ্যামিলি যোগাযোগ করেনি।’
এ ধরনের আসামিরা সংগঠিত হয়ে মিছিল করল কিন্তু গ্রেফতারের পর তার ফোন কেন জব্দ তালিকায় দেখিয়ে পরবর্তীতে ফরেনসিক করা হবে না-জানতে চাইলে ডিসি বলেন, ‘এটা কেন করা হলো না দেখতে হবে।’
উল্লেখ্য, আসামি গ্রেফতার ও তার কাছ থেকে উদ্ধার মালামাল জব্দের বিষয়ে আইনে স্পষ্ট বলা আছে। জব্দ তালিকা ফৌজদারি কার্যবিধি ২০১৮-এর ১০৩(২) ধারা এবং পুলিশ প্রবিধানের ২৮০ বিধান অনুযায়ী প্রস্তুত করা হয়। জব্দ তালিকা তৈরি করার পর যত দ্রুত সম্ভব এটি আদালতে পেশ করতে হবে। এ বিষয়টি স্পষ্ট বলা আছে।
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক আইজি মোহাম্মদ নুরুল হুদা গণমাধ্যমে বলেন, গ্রেফতারের পর আসামি যখন ফরওয়ার্ড হয়ে যাবে, তখনই কোর্টকে বলতে হবে তার কাছে কী কী পাওয়া গেছে। সেগুলো সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাছে থেকে যায়, পুলিশের কাছে আসে না।’
জানা যায়, রাজধানীর ধানমন্ডি থানাধীন ৩২ নম্বর সড়ক সংলগ্ন মিরপুর সড়কে গত ৩১ আগস্ট দুপুরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ৮০ থেকে ৯০ জন সদস্য মিছিল করে। মিছিল থেকে ককটেলও বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় সন্ত্রাসবিরোধী ও বিস্ফোরক আইনে একটি মামলা হয়। ওই মামলায় গত ৬ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর নিউমার্কেট থানাধীন একটি হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শেখ ইবনে সাবিতকে। ডিবি লালবাগ বিভাগ তাকে গ্রেফতার করে দুটি মোবাইল ফোনসহ ডিবি রমনা বিভাগে হস্তান্তর করে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর মো. আখতার মোর্শেদ গত ৭ সেপ্টেম্বর ফোনগুলো ডিবি লালবাগ বিভাগের কাছ থেকে লিখিতভাবে বুঝে নেন। কিন্তু আদালতে আসামি উপস্থাপনের সময় মোবাইল ফোন জব্দ তালিকায় দেখানো হয়নি। ঘটনার ১৫ দিন অতিবাহিত হলেও মোবাইল ফোনের কোনো তথ্য গ্রেফতারকৃতের স্বজনদের জানানো হয়নি। ওই মামলায় গ্রেফতার অন্যদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে এ ঘটনার পর ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মোবাইল উদ্ধারের প্রার্থনা ও কললিস্ট যাচাইয়ের আবেদন করেছেন ইবনে সাবিত। আবেদনে বলা হয়েছে, আসামিকে গত ৬ সেপ্টেম্বর ডিবি পুলিশ নিউমার্কেট থানাধীন হোম কেয়ার হাসপাতাল থেকে সঙ্গে থাকা আইফোনসহ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। যা সিসিটিভি ফুটেজে শনাক্ত। তদন্তকারী কর্মকর্তা আইফোনটি জব্দ তালিকার অন্তর্ভুক্ত না করে আদালতে গ্রেফতার প্রতিবেদন দাখিল করেন। আবেদনে আরও বলা হয়েছে, দরখাস্তকারী আসামি গত ৩১ আগস্ট ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য খুলনা বিআরটিএ অফিসে সশরীরে উপস্থিত থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। তাকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে।
শীর্ষনিউজ