
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের বর্ষপূর্তির দিন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন আয়োজন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অব্যাহত দাবি, চাপ ও নানা সংশয়-সন্দেহের মধ্যে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অর্থাৎ রোজা শুরুর আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার কারণে ১৫ বছর ধরে নাগরিকরা ভোট দিতে পারেনি। এবারের নির্বাচনে আমরা আমাদের বকেয়া আনন্দসহ মহানন্দে ভোট দিতে চাই।
জনমনে নির্বাচন নিয়ে এখনো নানা প্রশ্ন। নির্বাচন কি প্রচলিত আসনভিত্তিক পদ্ধতিতে হবে, নাকি কয়েকটি দলের দাবি মেনে সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে হবে? কতগুলো দল এ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে? জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে সংবিধান সংশোধনের জন্য গণভোটও কি অনুষ্ঠিত হবে? নাকি নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের সংবিধানসংক্রান্ত সংস্কার জুলাই ঘোষণার ২২ দফার ক্ষমতাবলে একটি ‘সাংবিধানিক আদেশ’ জারি করে সম্পন্ন করা হবে? জুলাই ঘোষণার ২৫ দফায় তো বলা হয়েছে, নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে সংস্কার সম্পন্ন হবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের আগেই এই সংস্কার কি সম্ভব? এ ধরনের আরো অনেক প্রশ্নের জবাব এখনো অজানা।
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর পরবর্তী বৈঠক আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে হতে পারে। এ অবস্থায় আপাতত জুলাই সনদ অগ্রগতি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে তেমন কিছু জানা যাচ্ছে না।
এদিকে এই পরিস্থিতির মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা গত বুধবার ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্যদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, কিছু মহল এখনো ভোট পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন নিশ্চিত করতে অটল।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ সাতটি রাজনৈতিক দল গতকাল থেকে কয়েকটি অভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করেছে সে বিষয়টিও এখন অন্যতম আলোচনার বিষয়।
দলগুলোর মধ্যে সংসদের উভয় কক্ষে সংখ্যানুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা)। খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির পক্ষে। নেজামে ইসলাম পার্টি পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে। জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবি বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন বাদে অন্য ছয়টি দলের। অভিন্ন দাবিগুলোর বাইরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গানের শিক্ষক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি রয়েছে বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের।
গতকালের বিক্ষোভ সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক মহলের প্রভাবের কারণে সরকার সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে পারছে না। গত ৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা জুলাই ঘোষণা উপস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু বিশেষ মহলের প্ররোচনায় সেখানে জনআকাঙ্ক্ষাবিরোধী অনেক বিষয় যোগ হয়। আমরা তা সংশোধনের দাবি জানিয়েছিলাম। যদি নির্বাচনের আগে তা সংশোধন না হয়, তবে দেশ ভয়াবহ সংকটে পড়তে পারে।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের বিক্ষোভ সমাবেশে দলের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেন, ‘এত রক্তক্ষয়ী ও গৌরবময় গণ-আন্দোলনের পরও আজ রাজপথে এসে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করা, হত্যাকারীদের বিচার এবং ফ্যাসিবাদী অপশক্তির দমন—এমন ন্যায্য দাবিগুলো নিয়ে আন্দোলন করতে হবে, তা কখনো কল্পনাও করিনি।’
এদিকে বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ চলাকালে প্রায় একই ইস্যু ও সময়ে রাজপথে কর্মসূচি ঘোষণা করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে। বলা হয়, এটি নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা, এর মাধ্যমে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে। গত বুধবার ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে এই ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।
সার্বিক এই অবস্থায় নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতিমূলক কাজেও প্রভাব ফেলেছে। নির্বাচন কমিশন তাদের রোডম্যাপে চলতি মাসের শেষের দিকে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ শুরু করার কথা বলেছিল। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ওই সংলাপ পিছিয়ে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমান মাসুদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বিদ্যমান বিধি-বিধান অনুসারেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি এবং আশা করছি ঘোষিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হলে তাদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বিধি-বিধান ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন এলে সে পরিবর্তন যদি সহজ হয়, তাহলেও সমস্যা হবে না। আর সহজ যদি না হয় তাহলে কী করব এই মুহূর্তে সে সম্পর্কে মন্তব্য করা যাচ্ছে না।’
আপনারা এরই মধ্যে নির্বাচনী কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। তাতে বলা আছে, সেপ্টেম্বরের শেষ দিন থেকে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ শুরু করবেন। সেটি কি করতে পারছেন? পারলে সংস্কারসংক্রান্ত বিদ্যমান অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ওই সংলাপ কতটা সুফল বয়ে আনবে—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মপরিকল্পনায় সম্ভাব্য একটা সময়ের কথা বলা আছে। কিন্তু জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সময় জুলাই সনদের বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় আনার জন্য এক মাস বাড়ানো হয়েছে। এই এক মাস সময়ের আগেই হয়তো সমঝোতা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমাদের সংলাপের সময়ও কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। জুলাই সনদের বিষয়টি পরিষ্কার না হলে রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের সঙ্গে সংলাপে কী মতামত দেবে, আর আমরা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেই বা তাদের কী বলব? সে ক্ষেত্রে পুরোদমে নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজের মধ্যেও নির্বাচন কমিশনকে কিছু বিষয়ে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।’
বিশেষজ্ঞ মত : নির্বাচনকেন্দ্রিক বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে ছিল না এবং কমিশন সভায় আলোচনায় আসেনি—এমন কিছু বিষয় বাস্তবায়নের দাবিতে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের একই সঙ্গে মাঠে নামাতে অনেকের সন্দেহ, এসবের পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন, কিছু মহল এখনো ভোট পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমার মনে হয়, বড় একটি দল খেলায় নেমেছে। এই খেলতে গিয়ে দলটি বিপদেও পড়তে পারে।’
অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ আরো বলেন, যেসব সংস্কার প্রস্তাব এসেছে সেসব সংস্কার প্রস্তাব আগামী নির্বাচনের আগেই সব কেন বাস্তবায়ন করতে হবে? সংস্কারের জন্য কেন এত সময় নেওয়া হবে? জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষিদ্ধ করার সময় উঠল না কেন—এসব প্রশ্ন অনেকের।
তিনি আরো বলেন, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের মধ্যে যে অনাস্থা প্রকাশ পেয়েছে, তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। দলগুলোকে দলীয় ও ব্যক্তি স্বার্থের বাইরে এসে দেশ ও দেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষার কথা ভাবতে হবে।
রাজনৈতিক শক্তিগুলোর দায়িত্বশীল আচারণ জরুরি : রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যথাসময়ে নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ, সংশয় ও সংকট উত্তরণে সরকার ও গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর দায়িত্বশীল আচরণ জরুরি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী নির্বাচন উৎসবমুখর হতে হলে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। সংস্কার বাস্তবায়নের পরই নির্বাচন উৎসবমুখর হবে। এখন এই বাস্তবায়নের দিকটাই আমরা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে তাদের একটা জায়গায় কিভাবে আনা যায় সে উপায়টা খোঁজার চেষ্টা করছি। আমরা আশা করি, রাজনৈতিক দলগুলো হয়তো নিজেদের দলীয় অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে তাদের ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে জনগণের স্বার্থে একটা জায়গায় আসতে পারে। যদি সব রাজনৈতিক দল জুলাই সনদ নিয়ে এক জায়গায় আসতে পারে তাহলে আমার মনে হয়, নির্বাচন নিয়ে যে শঙ্কা আছে তা কেটে যাবে এবং সবাই তখন নির্বাচনমুখী হবে। ভোটার থেকে শুরু করে যাঁরা প্রার্থী সবাই তখন নির্বাচনকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দেবে।’
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা কালের কণ্ঠকে বলেন, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জনমনে তিন ধরনের আশঙ্কা আছে। এক. নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে আসলেই হবে কি না, দুই. নির্বাচন হলেও তা বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে কি না, তিন. নির্বাচন হলেও তা সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ করা সম্ভব হবে কি না—এসব শঙ্কার কারণ সরকারের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব। সরকার গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছে। তাদের মতামত নিয়ে দেশ পরিচালনা করেনি। সরকার গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা অনুসারে দেশ পরিচালনা করতে না পেরে জনসমর্থন হারিয়েছে। বড় বড় রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাবে জুলাই সনদকে নিজের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে দেশকে অনিবার্য সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কিংবা বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিচ্ছে। ফলে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। এই অবস্থায় সন্দেহ, সংশয় ও সংকট উত্তরণে সরকার ও গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর দায়িত্বশীল আচারণ জরুরি।