Image description

হাসিনার দুঃশাসনে সিরাজগঞ্জে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা বিভীষিকাময় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নেতাকর্মীদের হত্যা, তাদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট করা হয়েছে। হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনে বিএনপির ৩২ ও জামায়াতের ১৩ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। গুম করে হত্যা করা হয়েছে যুবদলের তিন নেতাকর্মীকে। পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন তিনজন। চোখ হারিয়েছেন ১০ জন।

আহত হয়েছেন শত শত নেতাকর্মী। গুলিতে আহত হয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপি সভাপতি রোমানা মাহমুদ। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে প্রায় ৩০ নেতাকর্মীর। একাধিকবার ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে জেলা বিএনপি কার্যালয়। পুলিশের রাইফেল কেড়ে নিয়ে বেলকুচিতে ছাত্রশিবিরের দুই কর্মীকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় থানা ও আদালত কোনো মামলা নেয়নি। বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাত শতাধিক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। দলীয় সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, হাসিনার দুঃশাসনে সিরাজগঞ্জে বিএনপি নেতাকর্মীরা অকল্পনীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। সিরাজগঞ্জ সদর আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবে মিল্লাত মুন্না নির্যাতন-নিপীড়নে ছিলেন এগিয়ে। তিনি হাসিনার আত্মীয় হওয়ায় (সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ননদের স্বামী) ছিলেন বেপরোয়া। আর তাকে সহযোগিতা করেছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন এবং পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি হেলাল উদ্দিন। তখন সিরাজগঞ্জ শহরে বিরোধী দলের মিছিল-মিটিং ছিল নিষিদ্ধ।

পুলিশের সাজানো মামলায় বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের হয়রানি ও কারাগারে আটক রাখা হতো। ৩৫০টির মতো মামলায় জ্ঞাত-অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে প্রায় ১০ লাখ নেতাকর্মীকে। রাজশাহী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে একটি মিথ্যা মামলায় জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ সুইটসহ সাতজনকে যাবজ্জীবন ও ৯ জনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

নিহতের পরিবার ও মামলা সূত্রে জানা যায়, সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়ন যুবদলের সহসভাপতি জবান আলীর পরিবারের কাছে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন একই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান নবীদুল ইসলাম। চাঁদার টাকা না পেয়ে ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি জবান আলীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় তারা। পরে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিলেও জবান আলীকে ফেরত দেয়নি।

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সদর উপজেলার কোনাগাতী ব্রিজ এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এছাড়া চাঁদা না পেয়ে ২০১৪ সালের জানুয়ারি গুম করা হয় সয়দাবাদ ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড যুবদল সভাপতি বাবলু ও যুবদলকর্মী জাহাঙ্গীর হোসেনকে। পরে জাহাঙ্গীরের লাশ কামারখন্দ উপজেলার ঝাঐল ওভারব্রিজ এলাকা থেকে উদ্ধার করে এলাকাবাসী। পরবর্তীতে সদর উপজেলার বিয়ারাঘাট এলাকা থেকে বাবলুর লাশ উদ্ধার করা হয়। এভাবে বিএনপি নেতাকর্মীদের হত্যা করে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।

জাহাঙ্গীর হত্যার প্রধান আসামি সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবে মিল্লাত মুন্না। নিহত যুবদল নেতা জবান আলীর ভাই আব্দুল হামিদ আমার দেশকে বলেন, ‘আমাদের বাড়িঘরে হামলা করে ব্যাপক লুটপাট করা হয়েছিল। অগ্নিসংযোগ করা হয় পুরো বাড়িতে। ঘরের আসবাবপত্র, গরু-ছাগল সবকিছু লুটে নেয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। লেপ-তোশক কিছুই ছিল না। আমাদের প্রায় এক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। শুধু জবান আলীকিই ১৪ মামলার আসামি করা হয়েছিল। বাড়ির এমন কোনো মানুষ নেই যাদের হয়রানি বা মামলা দেওয়া হয়নি। আমাদের একেবাবে নিঃস্ব করে দিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রশাসন ও এমপি হাবিবে মিল্লাত মুন্নার সহযোগিতায় আমাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়েছে। ২০ লাখ টাকা চাঁদা না দেওয়ায় আমার ভাই জবান আলীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে। এমন কোনো নির্যাতন নেই যে, আমাদের ওপর করা হয়নি। নবীদুল চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এ ঘটনা ঘটেছে। আমি আমার ভাই হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।’

নিহত বাবলুর মা ভানু খাতুন বলেন, আমার ছেলে তাঁতের কাজ করে সংসার চালাত। বিএনপি করার কারণে আমার ছেলেকে অপহরণ করে খুন করা হয়। বাড়িঘরে হামলা করে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে আমাদের সবকিছুই শেষ হয়ে যায়। বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছিলাম। এত নির্যাতন কোনোদিন দেখিনি। ছেলেটাকে তুলে নিয়ে খুন করা হলো। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই; ফাঁসি চাই। মরণের আগে যেন হত্যাকারীদের ফাঁসি দেখে যেতে পারি।’

জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা মোস্তফা জামান বলেন, বিগত ১৭ বছর সিরাজগঞ্জে বিএনপি নেতাকর্মীরা হয়রানি ও গুমের শিকার হয়েছেন। সয়দাবাদে যুবদলের তিন নেতাকে গুমের পর হত্যা করা হয়েছে। অসংখ্য নেতাকর্মী মামলার আসামি। আমি নিজেও ২০ মামলার আসামি। কারাগারে থাকতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। দলীয় কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হয়নি। শহরে মিছিল করতে পারিনি। অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। বারবার দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। শেখ হাসিনা জগদ্দল পাথরের মতো আমাদের চেপে ধরে রেখেছিল। মহিলা দলের নেত্রী মেরিনা জাহান মেরি, জেলা বিএনপি নেতা শামীম হোসেন হিটলারসহ অনেক নেতা পুলিশের গুলিতে চোখ হারিয়েছেন। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। জেলা বিএনপি সভাপতি ও সাবেক এমপি রোমানা মাহমুদ গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। আমার নিজেরও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল। মামলার কারণে পলাতক ও কারাগারে থাকতে হয়েছে। এখন আর ব্যবসাও নেই।’

জেলা বিএনপি সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু বলেন, ‘হাসিনার দুঃশাসনের কথা আমরা কোনোদিন ভুলব না। স্টিম রোলার চালানো হয়েছিল আমাদের ওপর। হামলা-মামলা করে নেতাকর্মীদের নিঃস্ব করে দেওয়া হয়েছে। আমি নিজেও প্রায় ৭০ মামলার আসামি। একাধিকবার কারাগারে আটক ছিলাম। আন্দোলনের মাঠে থাকার কারণে আমাকে গুম করার চেষ্টা করা হয়। জেলায় এমন কোনো নেতাকর্মী নেই, যাদের নামে মামলা ছিল না। হাসিনার সময়ে আমাদের প্রায় ৪০ নেতাকর্মী গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। অসংখ্য নেতাকর্মী পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণ করছেন । দলীয় কর্মসূচি পালন করতে গেলেই আমাদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক ও ডাকাতি মামলা দেওয়া হতো। মিথ্যা মামলায় জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ সুইটসহ ৩০ নেতাকর্মীকে সাজা দেওয়া হয়েছে। গত ১৫ বছর আমরা এভাবেই নির্যাতনের শিকার হয়েছি।’

জেলা জামায়াত নেতারা জানান, হাসিনার দুঃশাসনকালে দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তত সাড়ে ৩০০ মামলা করা হয়েছে। জামায়াত নেতাকর্মীদের আটক করতে মামলা লাগেনি। আটক করে সরকারি কাজে বাধাদান, চুরি, ডাকাতি, বিস্ফোরক মামলা তৈরি করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অনেক নেতাকর্মীকে আটকের পর পুলিশ কয়েকদিন পর আদালতে পাঠাত। জামিনে মুক্তি পেলে কারাফটক থেকে আবার গ্রেপ্তার করে অন্য মামলায় আদালতে পাঠানো হতো।

২০১৩ সালের ২৯ মার্চ বেলকুচিতে পুলিশের রাইফেল কেড়ে নিয়ে ছাত্রশিবিরকর্মী ইউনুস আলী ও ফরিদুল ইসলামকে হত্যা করেছে তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু বিচারক মামলা খারিজ করে দেন। উল্টো পুলিশ বাদী হয়ে জামায়াত নেতাকর্মীদের নামে মামলা দায়ের করে। জামায়াতের ১৩ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে মুক্তার হোসেন ও রুহুল আমিন নামে দুই কর্মীকে উল্লাপাড়া থানার মধ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। সুমন নামে এক কর্মীকে হত্যা করা হয় সিরাজগঞ্জ সদর থানার মধ্যে । নিহত ইউনুস আলীর বাবা আব্দুল হামিদ সরকার বলেন, ‘আমার ছেলে দৌলতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রৈণির ছাত্র ছিল। পাশাপাশি বাজারে আমাদের ব্যবসা দেখাশোনা করত। মারামারির কথা শুনে দোকান বন্ধ করে বাড়ি আসার পর সাবেক মন্ত্রী লতিফ বিশ্বাসের গুলিতে সে মারা যায়।’

তিনি বলেন, ‘বাড়িতে লাশ আনতে পারিনি। ধানক্ষেতে লুকিয়ে রাখা হয়। পরে মামলা করতে কোর্টে গিয়েছিলাম। কিন্তু মামলা খারিজ করে দেন বিচারক। উল্টো পুলিশ আমাদের নামে মামলা করে। বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে হয় আমাদের; এখন মামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছি। আমার ছেলেকে সাবেক মন্ত্রী হত্যা করেছে। আমি তার বিচার চাই। তাকে ফাঁসি দেওয়া হোক।’ বেলকুচি উপজেলার কল্যাণপুর রওশনিয়া দাখিল মাদরাসার অফিস সহকারী মওলানা আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘সাবেক মন্ত্রী লতিফ বিশ্বাস ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর অত্যাচারে আমরা বাড়িঘরে থাকতে পারিনি। মামলা দিয়ে হয়রানি করা হতো। এলাকার এমন কোনো লোক নেই যাদের বিরুদ্ধে মামলা নেই। যেদিন ইউনুস ও ফরিদুলকে হত্যা করা হলো, সেদিন এলাকায় কোনো লোকজন ছিল না। মসজিদের মাইকে আজান পর্যন্ত দিতে দেওয়া হয়নি।

গুমের শিকার জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম বলেন, ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আমি কর্মস্থল নলকা ফুলজোর ডিগ্রি কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। চণ্ডিদাসগাতী ব্রিজের কাছে পৌঁছালে সাদা পোশাকের পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে। পরে আমার চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখে। এর অনেক পর ঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি আমাকে সিরাজগঞ্জ পুলিশ লাইনসে একটি কক্ষে আটক করে রেখেছে। এ সময় আমার ওপর ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। পরবর্তীতে আমাকে আদালতে পাঠানো হয়।’

জেলা জামায়াতের সেক্রটারি অধ্যাপক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘২০০৯ সালে উল্লাপাড়া জামায়াত নেতা সাইফুল ইসলামকে গুপ্তহত্যার মধ্য দিয়ে হাসিনার আসল চরিত্র ফুটে ওঠে। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর এনায়েতপুরে অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বাড়ি ফেরার পথে জামায়াতকর্মী ওয়ারেছ আলীকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। ২০১২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের পর পুলিশের নির্বিচারে গুলিতে সদর উপজেলার চণ্ডিদাসগাতীতে মুক্তার ও রুহুল আমিন নামে দুই কর্মী নিহত হন। ২০১৩ সালের ৪ মার্চ উল্লাপাড়া মাহফুজ নামে এক কর্মীকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। ২০১৪ সালের ৯ এপ্রিল বেলকুচিতে আলমগীর নামে এক কর্মীকে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে। শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তার পরিবারকে বেলকুচি থেকে বিতাড়িত করেছে। উল্লাপাড়া ও সদর থানায় দুই কর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি গুমের শিকার হয়েছেন জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম। উল্লাপাড়ার তৎকালীন সেক্রেটারি মাওলানা তৈয়ব আলীকে এক মাসেরও বেশি সময় গুম করে রাখা হয়েছিল। শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের জেলা সেক্রেটারি সোলাইমান হোসেনকে গুম করে রাখা হয়। প্রায় দেড় মাস পর তিনি মুক্তি পান।