
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দাওয়াতি কাজ থেকে ফেরার পথে গুম হয়েছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র আমিনুল ইসলাম। গুম অবস্থায় নির্যাতনের ফলে তিনি মারা যান। এ ঘটনার প্রায় দুবছর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব ও সংস্থাটির ছয় কর্মকর্তাকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল জাতিসংঘ।
হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে নানা নাটক সাজায় র্যাব। সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে বম গোষ্ঠীর সঙ্গে জঙ্গি প্রশিক্ষণে গিয়ে বন্ধুদের হাতে খুন হন আমিনুল। পরে পাহাড়েই তাকে কবর দেওয়া হয়। এমনকি লাশ দেখানোর নামে গহীন পাহাড়ে তার বাবাকে নিয়ে যাওয়া হলেও সেখানে কিছুই পাওয়া যায়নি।
তবে আমার দেশ-এর অনুসন্ধান ও গুম থেকে ফিরে আসা তিন তরুণের সাক্ষ্যে উঠে এসেছে ভিন্ন তথ্য। তারা জানান, ২০২২ সালের নভেম্বরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ফেরার পথে র্যাব চারজনকে ধরে নিয়ে যায়। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত আমিনুলকে প্রথমে র্যাব-৭-এর গোপন সেলে এবং পরে সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার নির্যাতনে মারা যান আমিনুল।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্যে, প্রত্যেকের জন্য আলাদা গল্প সাজানো হয়েছিল। কখনো বলা হয়েছে তারা জঙ্গি প্রশিক্ষণে গেছে, কখনো বলা হয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে তাদের।
২০২২ সালের ২৩ আগস্ট কুমিল্লার আলমপুর থেকে স্থানীয় তাবলিগ জামাতের সঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যান আমিনুল। পরিবার প্রথমে ভেবেছিল তিনি ধর্মীয় সফরে আছেন। কিন্তু খোঁজ না পেয়ে ১ সেপ্টেম্বর স্বজনরা কুমিল্লা র্যাব অফিসে ছবি ও তথ্য জমা দেন এবং থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন।
আমিনুলের বাবা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ভেবেছিলাম কোথাও গেছে; কিন্তু ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার পর দেখি একই দিনে আরো কয়েক তরুণ নিখোঁজ।’
চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি গুম-সংক্রান্ত কমিশনে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করেন নুরুল ইসলাম।
দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে আমিনুল ছিলেন মেজ। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট ভাই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র।
মৃত্যু পাহাড়ে নয়, র্যাব হেফাজতেই হয়েছিল : ‘কবর নাটক’, এরপর নতুন চাপ
জামিনে মুক্ত তিন তরুণ জানান, র্যাবের গোপন সেলে নির্যাতন সইতে না পেরে মারা যান তাদের সহবন্দি আমিনুল ইসলাম। মৃত্যুর খবর আড়াল করতে র্যাব কর্মকর্তা আলেপ উদ্দীন পরিবারকে জানান, আমিনুল পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণে গিয়ে অসুস্থ হয়ে মারা গেছে এবং সহকর্মীরাই তাকে দাফন করেছে।
পরবর্তীকালে র্যাবের হেলিকপ্টারে বাবাকে নিয়ে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় দেখানো হয় একটি সদ্য খোঁড়া কবর; সঙ্গে ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট, চিকিৎসক ও সাংবাদিক। তবে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কবরে হাত দিয়ে দেখেছিলাম কোনো গন্ধ বা চিহ্ন ছিল না, সব সাজানো মনে হয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘আলেপ উদ্দীন আমাকে জানান, ‘আপনার ছেলে মারা গেছে।’ আমি প্রমাণ চাইলে তিনি বলেন, ‘বন্ধুরা দায়ী।’ এরপর আমাকে আলাদা রুমে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘মামলা না করলে যেতে পারবেন না।’ অবশেষে বান্দরবানের রুমা থানায় জোরপূর্বক মামলা রুজু করা হয়, যেখানে নাথান বমসহ ২১ জনকে আসামি করা হয়। এদের মধ্যে অনেকেই র্যাবের কাছে গুম ছিলেন।’
মামলার পর র্যাব কয়েক তরুণকে হাজির করে। তারা আলেপের সাজানো বক্তব্য দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমিনুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে মারা গেছে।’ দাফনের ঘটনায় নাম আসা সামির নামে একজন পরে অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি তখন পাহাড়ে ছিলামই না।’
নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তখন নিশ্চিত হই সব গল্প, সাজানো।’ পুলিশের এক তদন্ত কর্মকর্তা অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছিলেন, ‘ভাই, র্যাব যা করেছে, সবকিছুই সাজানো মনে হচ্ছে।’
অনুসন্ধানে নাটকীয় মোড়
র্যাবের গোপন সেলে নির্যাতনে কুমিল্লার তরুণ আমিনুল ইসলামের হত্যাকে আড়াল করতে র্যাব কর্মকর্তা আলেপ উদ্দীন প্রথমে চেষ্টা করেন ঘটনাটি যেন ‘জঙ্গি প্রশিক্ষণকালে সহকর্মীদের হাতে মৃত্যু’ বলে চালাতে। কিন্তু গুম থেকে ফিরে আসা তিন তরুণ এই সত্য প্রকাশ করেন।
কামরাঙ্গীরচরের আবুল কালামের ছেলে মোহাম্মদ রায়হান জানান, ২০২১ সালের ৯ অক্টোবর তাকে যাত্রাবাড়ী থেকে র্যাব তুলে নেয়। র্যাব-১ ও পরে র্যাব-৭-এর গোপন সেলে তিনি আমিনুলকে দেখেছেন। ভীষণ অসুস্থ অবস্থায় আমিনুল প্রায়ই দাদার কথা ভেবে কাঁদতেন। এক রাতে র্যাবের আলেপ উদ্দীন ও ইকবালের নেতৃত্বে কয়েকজন তাকে নিয়ে যায়। কিছু ওষুধ খাওয়ানোর পর ফের নিয়ে যাওয়া হলে তিনি আর ফিরে আসেননি। রায়হান বলেন, ‘সবাই জানত আমিনুলকে হত্যা করা হয়েছে। ১৬ মাস গুম থাকার পর রায়হানকে কারাগারে পাঠানো হয় এবং ২০২৪ সালের নভেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পান।’
একইভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ফেরার সময় কুমিল্লার বায়েজিদ হাসানও র্যাবের হাতে গুম হন। তিনি জানান, নির্যাতনের পর আলাদা করে ফেলে দেওয়া হলে জানতে পারেন আমিনুল আর বেঁচে নেই। তার বাবার করা হত্যা মামলায় অন্যদের মিথ্যা আসামি বানানো হয়।
সিলেটের তাহিয়াত চৌধুরীও র্যাব-১-এর গোপন সেলে আমিনুলকে দেখেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমিনুল ম্যালেরিয়ায় দুর্বল থাকায় টর্চার সহ্য করতে পারছিলেন না।’ এক র্যাব কর্মকর্তা হুমকি দিয়েছিলেন, ‘আজকে ওই ম্যালেরিয়া রোগীটাকে মাইরা চেয়ার ভাঙছি।’ পরে জেলে গিয়ে বায়েজিদের কাছ থেকে নিশ্চিত হই, টর্চারের কারণেই আমিনুল মারা যান এবং তার লাশ গুম করা হয়।’
তাহিয়াতের অভিযোগ, আলেপ উদ্দীনের নির্দেশে এ হত্যাকে ‘জঙ্গিদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব’ হিসেবে চালানো হয়; যদিও আলেপের ফোনে লাশের ভিডিও ছিল।
আমিনুলের স্থানীয় কাকা মাসুদ গাজী জানান, শেখ হাসিনার পতনের পর আলেপ উদ্দীন তার কাছে ফোনে স্বীকার করেন, ‘আমার কোনো দোষ নেই, ঊর্ধ্বতনরা আমাকে বাধ্য করেছেন হত্যার দায় আমিনুলের দ্বীনি ভাইদের ওপর চাপাতে।’
২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের হওয়া একটি হত্যা মামলায় আলেপ উদ্দীনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০২৫ সালের ১৬ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে। একই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর জানান, গুম ও নির্যাতনের পাশাপাশি আলেপ একজন আসামিকে গুম করে রাখা অবস্থায় তার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া স্ত্রীকে রোজা ভাঙিয়ে ধর্ষণ করেছিলেন, যার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
পুলিশও র্যাবের নাটকের প্রমাণ পেয়েছে
র্যাবের চাপে দায়ের করা মামলার তদন্তে রুমা থানা-পুলিশ কোনো প্রমাণ পায়নি। তদন্ত কর্মকর্তা আল আমিন আদালতে জানান, লাশ মেলেনি; শুধু কিছু চাদর ও মাটি দিয়ে সাজানো কবরের মতো দেখানো হয়েছিল। পুলিশ প্রতিবেদনে আসামিদের নির্দোষ উল্লেখ করলেও আদালত নতুন করে পিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়।
তিন বছর কেটে গেলেও আমিনুল ইসলামের কবরের সন্ধান মেলেনি। বাবার আক্ষেপ, ‘অন্তত নিশ্চিত করে বলা হোক কোথায় দাফন করা হয়েছে অঅমার ছেলেকে।’
বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছেন কক্সবাজার পিবিআইয়ের ইন্সপেক্টর বাসু দেব সিং। তিনি বলেন, ‘এখনো আমরা কবরের সন্ধান পাইনি।’