
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তেরের (মাউশি) একটি প্রশিক্ষণে তিন দিনের সেশন চার দিন দেখিয়ে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এভাবে ভুয়া বিলের মাধ্যমে অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সংস্থাটির প্রশিক্ষণ শাখার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ আছে, শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন অভিযুক্তরা।
জানা গেছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ‘অভিযোগ প্রতিকার’, ‘ইন হাউজ’, ‘তথ্য অধিকার’, ‘প্রকল্প ব্যবস্থাপনা’, ‘ডি-নথি’, ‘এআই’, ‘লাইব্রেরি সায়েন্স’, ‘ই-জিপি’সহ ১২ থেকে ১৩টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। মাউশির দুটি অডিটোরিয়ামে মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তার প্রশিক্ষক হিসেবে একাধিক সেশন নেন। প্রশিক্ষণে দেশের বিভিন্ন সরকারি সংস্থার প্রায় দুই হাজার প্রশিক্ষণার্থী অংশগ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণগুলো সম্পাদনা করতে দুই কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
প্রশিক্ষণের বিল-ভাইচারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রশিক্ষণের প্রতিটি সেশন এক ঘণ্টা করে ছিল। একদিনে তিনটি সেশন নেওয়ার নিয়ম থাকলেও ভাউচারে পাঁচটি পর্যন্ত সেশন দেখানো হয়েছে। এছাড়া একজন প্রশিক্ষকদের অনেকেই দুই দিন এক ঘণ্টা করে প্রশিক্ষণ দিলেও বিল-ভাউচারে তিন দিনে ৩-৪টি এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঁচটি পর্যন্ত সেশন দেখানো হয়েছে। এভাবে অতিরিক্ত সেশন দেখিয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে মাউশির প্রশিক্ষণ উইংয়ের পরিচালক প্রফেসর সাঈদুর রহমান এবং সহকারী পরিচালক ড. জাহিদা বেগমের বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘ই-জিপি’ প্রশিক্ষণের চতুর্থ এবং পঞ্চম ব্যাচে প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন মাউশির অর্থ ও ক্রয় উইংয়ের উপ-পরিচালক আবু সাঈদ মজুমদা। চতুর্থ ও পঞ্চম ব্যাচের প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়েছিল ১৩-১৫ মে এবং ১৭-১৯ জুন। চতুর্থ ও পঞ্চম ব্যাচে আবু সাঈদ মজুমদার তিন দিন প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করলেও চারদিন করে বিল-ভাউচার তৈরি করে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
‘আমি দুই/তিনদিন দুটি করে সেশন পরিচালনা করেছি। প্রতিটি সেশন দুই ঘণ্টা করে ছিল। দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে প্রশিক্ষণ শেষ করেছি। প্রতিটি ব্যাচের প্রশিক্ষণ তিন দিন করে ছিল। চার দিনের বিল-ভাউচার কীভাবে করা হয়েছে সেটি প্রশিক্ষণ শাখাই বলতে পারবে।—আবু সাঈদ মজুমদার, উপ-পরিচালক, মাউশি
চতুর্থ ব্যাচের প্রশিক্ষণে আবু সাঈদ মজুমদার দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত টানা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ৬ ঘণ্টায় পাঁচটি সেশন পরিচালনা করা আদতে সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষকদের অনবরত কথা বলতে হয়। সেখানে টানা পাঁচটি সেশন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এ সময়ের মধ্যে নামাজ, খাওয়া এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজও করতে হয়েছে।
জানতে চাইলে মাউশির উপ-পরিচালক আবু সাঈদ মজুমদার দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমি দুই/তিনদিন দুটি করে সেশন পরিচালনা করেছি। প্রতিটি সেশন দুই ঘণ্টা করে ছিল। দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে প্রশিক্ষণ শেষ করেছি। প্রতিটি ব্যাচের প্রশিক্ষণ তিন দিন করে ছিল। চার দিনের বিল-ভাউচার কীভাবে করা হয়েছে সেটি প্রশিক্ষণ শাখাই বলতে পারবে।
প্রাপ্ত নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মাউশির মহাপরিচালক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আজাদ খান কোনো প্রশিক্ষণ দেননি। ‘ই-জিপি’ বিষয়ে প্রশিক্ষণের চতুর্থ ব্যাচের প্রশিক্ষণ উদ্বোধনের সময় পরামর্শমূলক বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি। এ বক্তব্যের জন্য কোনো সম্মানী নেওয়ার নিয়ম নেই। তবে তাকেও প্রশিক্ষক বানিয়ে বিল-ভাউচার করা হয়েছে। চতুর্থ ব্যাচের ১৩-১৫ মে এবং পঞ্চম ব্যাচের ১৭-১৯ জুন চলা প্রশিক্ষণে মাউশি মহাপরিচালককে প্রশিক্ষক দেখিয়ে দুটি সেশনের বিল করে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। চতুর্থ ব্যাচের প্রশিক্ষণ উদ্বোধনের সময় মহাপরিচালক বক্তব্য দিয়েছিলেন। এই বক্তব্য দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষক হিসেবে তার নামে বিল করা হয়েছে। তবে পঞ্চম ব্যাচের প্রশিক্ষণ উদ্বোধনের সময় উপস্থিত ছিলেন না মহাপরিচালক। তবুও তার নামে বিল-ভাউচার করেছে প্রশিক্ষণ শাখা।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ই-জিপি প্রশিক্ষণের নামে সরকারের অর্থ হরিলুট করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ না দিয়েও বিল-ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন মাউশির পরিচালক (প্রশিক্ষণ) প্রফেসর সাঈদুর রহমান এবং সহকারী পরিচালক ড. জাহেদা বেগম। এই দুই কর্মকর্তার যোগসাজসে প্রশিক্ষণের নামে টাকা লুটের মহোৎসবে মেতেছেন।’
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘প্রশিক্ষণে একজন কর্মকর্তার নামে দিনে পাঁচটি সেশন (৫ ঘণ্টা) দেখানো হয়েছে; যা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এর পরও একজন কর্মকর্তার নামে তিন দিনে ১৫টি সেশন থাকলেও ১৬টি সেশন দেখিয়ে বিল-ভাউচার করা হয়েছে। সবগুলো ভুয়া বিল-ভাউচার প্রফেসর সাঈদুর রহমানের কক্ষের আলমিরাতে তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে যেন তদন্ত না হয়, সেজন্য তারা শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে ফেলেছেন।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মাউশি পরিচালক (প্রশিক্ষণ) প্রফেসর সাঈদুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
সহকারী পরিচালক (প্রশিক্ষণ-২) ড. জাহিদা বেগম দেশের বাইরে থাকায় তার সাথে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি কিছুই বলতে চাচ্ছি না। আপনি তথ্যদাতার কাছ থেকে প্রমান নিয়ে নিউজ করবেন প্লিজ।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে মাউশি মহাপরিচালকের দপ্তরে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
‘প্রশিক্ষণে একজন কর্মকর্তার নামে দিনে পাঁচটি সেশন (৫ ঘণ্টা) দেখানো হয়েছে; যা কোনভাবেই সম্ভব নয়। সবগুলো ভুয়া বিল-ভাউচার তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে যেন তদন্ত না হয়, সেজন্য তারা শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে ফেলা হয়েছে।’
অডিটরদের সঙ্গে গোপন সমঝোতার অভিযোগ
প্রশিক্ষণের নামে ভুয়া বিল-ভাউচার করে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি আড়াল করতে মাউশির পরিচালক (প্রশিক্ষণ) প্রফেসর সাঈদুর রহমান, সহকারী পরিচালক ড. জাহিদা বেগম এবং ড. নীহার পারভীন গত ২১ আগস্ট শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের অডিটরদের সঙ্গে একটি গোপন বৈঠক করেন বলে জানা গেছে। ওই বৈঠকে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ভুয়া বিল-ভাউচারের কাগজপত্র ‘না দেখার’ সমঝোতা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
পরে ২৪ আগস্ট থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত মাউশিতে অডিট কার্যক্রম চালায় শিক্ষা অডিটের কর্মকর্তারা। তবে এই সময়ে প্রফেসর সাঈদুর রহমান দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত ‘কেএলআইসি লিড গ্লোবাল ওয়ার্কশপ-২০২৫’-এ অংশ নিয়েছিলেন। অডিটের সময় তিনি উপস্থিত না থাকলেও অডিট সম্পন্ন ঘোষণা করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট মহলে এ ঘটনায় তীব্র সমালোচনা উঠলেও এখনো পর্যন্ত কোনো তদন্ত করা হয়নি।
যদিও আর্থিক লেনদেন এবং গোপন সভার কথা অস্বীকার করেছেন মাউশিতে অডিট কার্যক্রম পরিচালনাকারী দলের প্রধান শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার তোফাজ্জল হোসেন। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘মাউশিতে দুই ধাপে অডিট সম্পন্ন হচ্ছে। প্রথম ধাপের অডিটের সময় প্রশিক্ষণ উইংয়ের পরিচালক দেশের বাইরে ছিলেন। তার অফিস কক্ষে প্রয়োজনীয় অনেক ডকুমেন্টস রয়েছে। তবে সেগুলো তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিল। সেজন্য তখন অডিট অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। দ্বিতীয় ধাপে ডিসেম্বরে আমরা পুনরায় মাউশিতে যাব। তখন বিল-ভাউচারগুলো দেখা হবে।’
অডিট শুরুর আগে মাউশি পরিচালকের রুমে গোপন বৈঠকের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মাউশিতে অডিট শুরু হয়েছে ২৪ আগস্ট থেকে। এর আগে আমি মাউশিতে যাইনি। কোনো গোপন বৈঠকও হয়নি। যারা এ ধরনের অভিযোগ করেছেন তারা মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন।’
যদিও অডিট কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেনের দাবি সঠিক নয় বলে মাউশির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘২৪ আগস্ট রবিবার ছিল। এর আগে বুধবার অথবা বৃহস্পতিবার তোফাজ্জল হোসেন পরিচালক সাঈদুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। আমরা নিজেরাই বিষয়টি দেখেছি।’