
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (মিটফোর্ড হাসপাতাল) রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের জন্য কেনা প্রায় দেড় কোটি টাকার তিনটি আলট্রাসাউন্ড মেশিন গায়েব করে বিক্রির ঘটনা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিলের পর ইতিমধ্যে প্রায় সাড়ে তিন বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সবাই বহাল-তবিয়তেই আছে। এমনকি তিনটি আলট্রাসাউন্ড মেশিন চুরির মূল হোতা যিনি, হাসপাতালের প্রধান সহকারী আব্দুর রহিম ভূঁইয়াকে ইতিমধ্যে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতিও দেয়া হয়েছে। যা অবাক করার মতো ঘটনাই বটে!
মন্ত্রণালয়ের তদন্তে দেখা যায়, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের জন্য সরকারী তহবিলের অর্থে ২০১৩ সালে স্থানীয় ‘ওয়ার্সী সার্জিক্যাল’ নামক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৪১ লাখ ৬০ হাজার টাকায় একটি জি-হেলথ কেয়ার ইউএসএ কোম্পানির আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন কেনা হয় (মডেল নম্বর লজিক পি ৫)। পরের বছর একই কোম্পানির আরেকটি মেশিন ৪২ লাখ টাকায় কেনা হয়। যা হাসপাতালের স্টক লেজার পৃষ্ঠা নম্বর ৪৭-এ লেখা রয়েছে। একই বছর আরেকটি মেশিন জিটুজি পদ্ধতিতে চীন সরকারের অনুদান হিসেবে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের মাধ্যমে মিটফোর্ড হাসপাতালে সরবরাহ করা হয় (মডেল নম্বর জন কেয়ার কিউ ৩ উহান, চায়না)। এটিও হাসপাতালটির স্টক লেজার পৃষ্ঠা নম্বর ৬৯-এ লেখা রয়েছে। ওই মেশিনটির দাম ৪৫ লাখ টাকা।
ক্রয় সংক্রান্ত চুক্তি ও কাগজপত্রে প্রতিটি মেশিনের লাইফটাইম ধরা আছে ১০ বছর। সেই হিসেবে ওই তিনটি মেশিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৩ ও ২০২৪ সালে। কিন্ত এসব অত্যাধুনিক মেশিন আসার পর পরই একটি চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। ২০২৩ ও ২০২৪ সাল পর্যন্ত মেশিনগুলোর মেয়াদ থাকলেও মাত্র তিন বছর ব্যবহার করার পর ইলেক্ট্রনিক সমস্যার কথা বলে প্রথমে মেশিনগুলোকে দীর্ঘ সময় অলস ফেলে রাখা হয়। মেরামতের নামে মাঝে দফায় দফায় কিছু সরকারি অর্থও খরচ করা হয়। পরে এক পর্যায়ে সেগুলো গোডাউনে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ওই মেশিনগুলো পরিত্যক্ত বানানোর জন্য গোডাউনে পাঠিয়ে দেন রেডিওলজি বিভাগের প্রধান। এরপরে রাতের আঁধারে বাইরে বিক্রি করে দেয়া হয়। সচল মেশিনগুলো পরিত্যক্ত দেখানোর কাজটিতে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং বিভাগের অফিস সহায়ক মো. মাসুদ রানা (সুমন) এবং তৎকালীন ওয়ার্ড মাস্টার বিল্লাল হোসেন। তবে এই দুজনকে দিয়ে মেশিনগুলো পরিত্যক্ত দেখানো এবং রেডিওলজি বিভাগের প্রধানকে দিয়ে পরিত্যক্ত ঘোষণার কাজটিতে নেতৃত্ব দেন হাসপাতালের প্রধান সহকারী আব্দুর রহিম ভূঁইয়া। স্টোরে রিসিভও করেন আব্দুর রহিম ভূঁইয়া নিজে। এরপরে রাতের আঁধারে স্টোর থেকে বের করে বাইরে বিক্রি করে দেয়ার কাজটিও হয় রহিম ভূঁইয়ার হাত দিয়েই। হাসপাতালের এই চিহ্নিত চক্র রাতের আঁধারে মেশিনগুলো বিপুল অঙ্কের টাকায় বাইরে বিক্রি করার ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে এ নিয়ে শোরগোল শুরু হয়। ফলে এ থেকে বাঁচার জন্য চক্রটি গোডাউনে একই রকমের অন্য তিনটি পুরোনো মেশিনের মোড়ক এনে রেখে দেয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্তে এসব ঘটনা প্রমাণিত হয়।
নিয়মানুযায়ী কোনো মেশিন কন্ডেম বা পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে ন্যাশনাল ইলেক্ট্রো মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট ওয়ার্কশপের (নিমিউ) বিইআর অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে মেশিনগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সারিয়ে তোলার অযোগ্য হলেই তা কন্ডেম করতে হয়। এছাড়া উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে কনডেম ঘোষণার বিধান রয়েছে। বর্ণিত মেশিন ৩টির ক্ষেত্রে কোনো কিছুই মানা হয়নি।
বস্তুত, মেশিনগুলো হাসপাতালে আসার পর থেকেই এগুলো আত্মসাতের জন্য তৎপর হয়ে ওঠে একটি চক্র। চক্রটি সুকৌশলে অকেজো মালামালের সঙ্গে এগুলো রেখে দেওয়ার টার্গেট নিয়ে বারবার কন্ডেম ঘোষণা করার জন্য নিমিউ বরাবর চিঠি লেখে। নিমিউর প্রকৌশলীরা প্রতিবারই মেশিনগুলো পরীক্ষা করে এগুলো ভালো আছে এবং ব্যবহার করার জন্য তাগিদ দেয়। কিন্তু চক্রটি তা কর্ণপাত না করে সুকৌশলে পরিত্যক্ত মালামালের গোডাউনে রেখে দেয়। আইন অনুযায়ী কন্ডেম ঘোষণার আগ পর্যন্ত পরিত্যক্ত কোনো মেশিন গোডাউনে রাখা অবৈধ। তারপরও রহস্যজনক কারণে ওই মূল্যবান মেশিনগুলো পরিত্যক্ত মালামালের সঙ্গে রেখে দেওয়া হয়। চক্রটি মেশিনগুলো ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি করে টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে বলে তাৎক্ষণিকভাবে জানাজানি হয়ে যায়। যদিও পরবর্তীতে দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে এরা মাত্র ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় বিক্রির কথা স্বীকার করেছে।
মেশিন তিনটি ইউনি হেলথ কেয়ারের ইঞ্জিনিয়ার রাজিবের নিকট মাত্র ১ লাখ ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছেন বলে দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে স্বীকার করেছেন আব্দুর রহিম ভূঁইয়াসহ সংশ্লিষ্টরা। ঘটনা জানাজানি হলে তিনটি ভিন্ন মেশিনের মোড়ক ইঞ্জিনিয়ার রাজিবের নিকট থেকে এনে স্টোর রুমে জমা দেওয়া হয়। রাজিবই আল্ট্রাসাউন্ড মেশিনগুলোর সার্ভিসিংয়ের মূল দায়িত্ব পালন করছিলেন। মূলতঃ ইউনি হেলথ কেয়ারের ইঞ্জিনিয়ার রাজিবের সহায়তায়ই সকল অপকর্ম হয়েছে। চক্রটি এসব মেশিন মেরামতের নামে ভুয়া ভাউচারে লাখ লাখ টাকা সরকারি অর্থও হাতিয়ে নিয়েছে।
অবাক ব্যাপার হলো, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং দুদক উভয় তদন্তেই তিনটি অত্যাধুনিক আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন নষ্ট দেখিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা, গোডাউনে নিয়ে যাওয়া এবং সেখান থেকে রাতের আঁধারে বিক্রি করে দেয়ার ঘটনা প্রমাণিত হওয়ার পরও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। উল্টো মেশিন আত্মসাত চক্রের মূল হোতা হেড কেরানী রহিম ভূঁইয়াকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন চুরির ঘটনায় অভিযুক্ত আরেক আসামি ওয়ার্ড মাস্টার বিল্লাল হোসেন ১০ বছর যাবত ভারপ্রাপ্ত ওয়ার্ড মাস্টার হিসেবে দায়িত্বে আছেন। অভিযোগ রয়েছে, বিল্লালের মাসে অবৈধ আয় কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। লেবার ওয়ার্ডে ২৫ জন দাইমা নেয়া হয়েছে। তাদের অনেকেই ওয়ার্ড মাস্টার বিল্লালকে ৩০ হাজার টাকা করে ঘুষ দিয়ে এ কাজে যোগদান করেছেন। তা ছাড়া প্রতিদিন ২০০ টাকা দিতে হয় তাকে। আউটসোর্সিংয়ের কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন না হলেও বকশিসের টাকা থেকে হলেও জনপ্রতি ২০০ টাকা দিতে হয় ওয়ার্ড মাস্টার বিল্লালকে। না দিলে ডিউটি থেকে আউট করার হুমকি দেন তিনি।
আদতে শুধু বিল্লাল হোসেনই নয়, পুরো হাসপাতালটি চলছে একটি চক্রে। অনিয়ম-দুর্নীতির এই চক্রের নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক প্রধান সহকারী এবং বর্তমান প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুর রহিম ভূঁইয়া। হাসপাতালের তিনটি দামী মেশিন রাতের আঁধারে বাইরে বিক্রি করে দেয়ার মতো নজিরবিহীন অপকর্ম প্রমাণিত হওয়ার পরও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তে উল্টো পদোন্নতির মাধ্যমে পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি। এতে রহিম ভূঁইয়ার নেতৃত্বাধীন চক্রের দাপট আগের চেয়েও বেড়েছে। অন্যদিকে হাসপাতালটির সেবার মান মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।