Image description

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের আড়ালে বিপুল অর্থ লুণ্ঠনের অভিযোগ রয়েছে। এমনকি দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়ে উন্নয়ন ব্যয়ের নামে বড় অংকের অর্থ খরচ করা হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রের দেনার পরিমাণ দিন দিন বেড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থার কেনাকাটার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি সরকারি ব্যাংকগুলোয় ঘটেছে অর্থ তছরুপের ঘটনা। গত বছরের আগস্টে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অনেকে প্রত্যাশা করেছিলেন অতীতে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের নামে অর্থ তছরুপের যেসব ঘটনা ঘটেছে সে বিষয়ে ফরেনসিক অডিট হবে। এর মাধ্যমে তছরুপকৃত অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেবে সরকার। যদিও গত ১৩ মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের দিক থেকে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার গতানুগতিক পদ্ধতিতেই কার্যক্রম চালিয়ে গেছে, যার কারণে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। অন্যদিকে সরকারের দাবি, সক্ষমতা অনুসারে যতটুকু সম্ভব সেটি করার চেষ্টা হয়েছে।

ফরেনসিক অডিট বলতে বোঝায় আর্থিক জালিয়াতি, অনিয়ম বা আর্থিক অপরাধ তদন্ত করার একটি বিশেষ ধরনের অডিট প্রক্রিয়া, যেখানে নিরীক্ষক আর্থিক রেকর্ড বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য জালিয়াতি খুঁজে বের করে প্রমাণ সংগ্রহ করেন। সাধারণ অডিটের লক্ষ্য যেখানে আর্থিক বিবরণীর নির্ভুলতা নিশ্চিত করা, সেখানে ফরেনসিক অডিটের মূল উদ্দেশ্য জালিয়াতি শনাক্ত করে এর পরিমাণ নির্ণয় এবং অপরাধীকে চিহ্নিত করা।

পতিত আওয়ামী সরকারের শাসনামলে ২০০৯-১০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১৫টি বাজেট বাস্তবায়ন করা হয়েছে। শুরুতে ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৫২১ কোটি টাকা, যেটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসে ৬ লাখ ১১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকায় পৌঁছায়। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে ৪৭ লাখ ৭৪ হাজার ৯১৩ কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ বাজেটের এক-তৃতীয়াংশই ছিল উন্নয়ন ব্যয়। এর মধ্যে ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার ১১৫ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এসে ২ লাখ ৯ হাজার ৯০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ১৫ বছরে উন্নয়ন খাতে বাজেট থেকে ১৬ লাখ ৭৯ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার।

গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার সময় দেশের ঘাড়ে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার সরকারি ঋণ রেখে যান। দেশী ও বিদেশী উৎস থেকে এ ঋণ নেয়া হয়েছে। অথচ ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। সে হিসাবে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে সরকারের ঋণ স্থিতি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বেড়েছে, যা সরকারের মোট ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ। মূলত উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য এ ঋণ নিয়েছিল পতিত সরকার।

আওয়ামী লীগের আমলে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বাস ও ট্রাক কেনা হয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) জন্য। ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান ও সুইডেন থেকে কেনা এসব বাস ও ট্রাকের একটা বড় অংশে কেনার কিছুদিন পর ত্রুটি দেখা দিতে শুরু করে। এ সময়ে কেনা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাস ও ট্রাক বিআরটিসির বহরে অচল অবস্থায় রয়েছে কিংবা নিলামে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে বিআরটিসির জন্য বাস ও ট্রাক কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তা কখনই তদন্তের উদ্যোগ নেয়নি তৎকালীন সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারও এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

অতীতে বিদেশ সফরের নামে রাষ্ট্রীয় অর্থের যথেচ্ছ অপচয় করতে দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের সময় বিশাল বহর নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ছিল বেশ সমালোচিত। এসব সফরে মন্ত্রী-আমলাদের পাশাপাশি দেশের আর্থিক খাতের অনেক লুটেরাও স্থান পেত। তাছাড়া প্রকল্পের নামে অভিজ্ঞতা অর্জন, সন্তানদের বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কিংবা সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে বিদেশ সফরে গিয়েছেন অনেক আমলা। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের নামে দেশের বাইরে সেমিনার, কর্মশালা ও রোড শোর মতো আয়োজনের মাধ্যমে সরকারি অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি এসবের আড়ালে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। অতিসম্প্রতি শ্রীলংকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে বিদেশ সফরের সময় রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের অভিযোগে কারাগারে যেতে হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দেশে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের নামে সফটওয়্যার কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আইসিটি বিভাগের তথ্যানুসারে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভাগটি বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচিতে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এর বাইরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ডিজিটালাইজেশন-সংক্রান্ত প্রকল্প নিয়েছে। গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) পর্যালোচনা সভায় তৎকালীন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম জানিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের আমলে টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি খাতে মোট ৬৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। এসব বিনিয়োগের বড় অংশের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো ফরেনসিক অডিট করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তবে গত ১৭ এপ্রিল বিগত সময়ে আইসিটি খাতের অনিয়ম দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রণয়নে একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। এ কমিটি এখনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি।

বিগত সরকারের দেড় দশক সময়ে দুর্নীতি, লুটপাটের একটি বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছিল দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো খাত। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং বেসমারিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের আটটি প্রকল্পে পরিকল্পনা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ত্রুটি, বাস্তবায়নে বিলম্ব ও দুর্নীতির কারণে প্রাক্কলিত বাজেটের চেয়ে ৬৮ শতাংশ বা ৭ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় বেড়েছে। প্রকল্পগুলো হলো পদ্মা সেতু প্রকল্প, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, যমুনা রেল সেতু প্রকল্প, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা এমআরটি লাইন-৬, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প ও বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লাইন-৩ প্রকল্প। এ প্রকল্পগুলোর প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, যা পরে বেড়ে ১৮ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

এ আট প্রকল্প ছাড়াও এ তিন মন্ত্রণালয় এবং নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আমলে বাস্তবায়ন করা হয়েছে বড় বড় প্রকল্প। বিশ্বের ব্যয়বহুল সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, এক্সপ্রেসওয়ে, রেলপথ নির্মাণ, রেলের ইঞ্জিন-কোচ সংগ্রহ, নৌযান-জাহাজ সংগ্রহসহ বিভিন্ন খাতে বাস্তবায়ন করা এসব প্রকল্পের ব্যয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চলে গেছে দুর্নীতি ও লুটপাটে।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর গত বছরের ২৮ আগস্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে সরকারি বিনিয়োগকে ঘিরে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। সরকারি কর্মকাণ্ডের জন্য ক্রয়কৃত পণ্য ও সেবায় ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা। এ অর্থ থেকে ঘুস হিসেবেই চলে গেছে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। এ ঘুস নিয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও তাদের সহযোগী ব্যক্তিরা। এ সময়ে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন বা ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৭ লাখ কোটি টাকা।

গত ১৫ বছরে অনিয়ম ও লুটপাটের আরেকটি বড় ক্ষেত্র ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অন্তত ৬০০ কোটি ডলার অনিয়ম-দুর্নীতির কথা উঠে আসে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে কমিশন, কেন্দ্র না চালিয়ে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ ও অতিরিক্ত মুনাফা হিসেবে এ অর্থ বেসরকারি খাত নিয়ে গেছে বলে উল্লেখ করা হয় শ্বেতপত্রে। স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে এলএনজি কেনাকাটায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বড় আকারে কমিশন বাণিজ্য হয়েছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের মাধ্যমে স্পট মার্কেটের এলএনজি চক্র গড়ে ওঠে বলে অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেশে এলএনজি আমদানি কার্যক্রমে চারটি কোম্পানি ঘুরেফিরে কাজ পেয়েছে। এগুলো হলো সিঙ্গাপুরের ভিটল এশিয়া ও গানভর, সুইজারল্যান্ডের টোটাল এনার্জিস ও যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, ৬০ শতাংশের বেশি এলএনজি সরবরাহ করেছে ভিটল এশিয়া ও গানভর। এ দুটি কোম্পানির সঙ্গে নসরুল হামিদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তার পরিবারের সদস্যের এ কোম্পানি দুটোর সঙ্গে ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতা ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভিটল এশিয়া থেকে এলএনজি আমদানি করা হয়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অতিরিক্ত ব্যয় ও আর্থিক ক্ষতি কমাতে মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন কমিটি করা হলেও আগের সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে ফরেনসিক অডিট করার উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতের পাঁচ ব্যাংকের ফরেনসিক অডিট শুরু করতে গিয়ে ফার্ম বাছাই ও অর্থ সংস্থানের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকারের অনুমোদন নিতে গিয়ে বেগ পেতে হয়েছে। সেখানে পাবলকি ফাইন্যান্সের বিষয়টিকে ফরেনসিক অডিটের আওতায় আনতে গেলে একটি সমন্বিত উদ্যোগ লাগবে। এক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ থেকে সিদ্ধান্ত আসতে হবে যে আমরা পাবলিক ফাইন্যান্সের ওপর একটি এক্সটার্নাল ইনক্লুডিং ফরেনসিক অডিট করতে চাই। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো এ ধরনের অডিটের একটি বড় ক্ষেত্র। তবে এ ধরনের বড় আকারের একটি ফরেনসিক অডিট করতে হলে সরকারের সব দপ্তর ও সংস্থার সমন্বিত অংশগ্রহণের প্রয়োজন হবে, যেটি বেশ অভাবনীয়। তার চেয়ে ছোট পরিসরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এগোনো সুবিধাজনক। স্বাস্থ্য খাতে একদিকে উন্নয়ন বরাদ্দের টাকা খরচ হচ্ছে না, অন্যদিকে এখানে ব্যাপক দুর্নীতির কথা শোনা যায়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকিসহ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করেও সমস্যা রয়ে গেছে। এখানেও দুর্নীতি রয়েছে। পরিবহন খাতও গুরুত্বপূর্ণ। ফলে রাঘববোয়ালদের দুর্নীতি ধরতে হলে এ ধরনের খাতগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগে ফরেনসিক অডিট করতে হবে। বর্তমান সরকারের মেয়াদ ও সক্ষমতার বিষয়টিও দেখতে হবে। বড় ধরনের আয়োজন করে কিছু করতে না পারার চেয়ে ছোট উদ্যোগ নিয়ে বড় কিছুর দিকে এগোনো ভালো।’

দেশে বর্তমানে ২৩২টি স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত ও বিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ থেকে সরকার সেভাবে কোনো রিটার্ন পাচ্ছে না। বরং এসব প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ দিতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে, ৩০ জুন ২০২৪ শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসব প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিল সরকার। এ ধরনের দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমও নিরীক্ষার উদ্যোগ নেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার।

ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ফরেনসিক অডিটের মতো উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক নয়। সরকারি রাজস্ব বিভিন্নভাবে ব্যয় করতে হয়, ভর্তুকি দিতে হয়। সরকারি যেসব খাতে অর্থ তছরুপ হচ্ছে তার পরিমাণ নির্ধারণ করে যদি সংস্কার করা যেত তাহলে সরকারি অর্থের অপচয় রোধ করা সম্ভব হতো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিগত এক বছরে সে ধরনের উদ্যোগ চোখে পড়েনি। আর্থিক সংস্কারের কথা যখন বলি তখন দরকার ছিল বিগত সময়ে যেসব খাতে অর্থ তছরুপ হয়েছে তার সব ধরনের পথ বন্ধ করে দেয়া।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ‘একটি সরকার চলে যাওয়ার পর যখন নতুন সরকার আসে তখন প্রথম দায়িত্ব ছিল পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে তার আলোকে সংস্কার করা। কিন্তু সে রকম কিছুই হয়নি। সরকারি অর্থে কেনাকাটা সঠিক ছিল কিনা তাও দেখা হয়নি। কোনো জায়গাই সঠিক পথে অগ্রসর হয়নি। সঠিক পথে যদি অগ্রসর হওয়া যেত তাহলে এক বছরে আর্থিক খাত একটি দিকনির্দেশনার মধ্যে চলে আসত যে আমাদের করণীয় কী হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা অগ্রসর হইনি, যার ফলে আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেয়ার পর পরই দেশের এক ডজনের বেশি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়। ওই ব্যাংকগুলোয় সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতি আর লুটপাট তদন্তে আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিযুক্ত করা হয়। এরই মধ্যে অন্তত ছয়টি ব্যাংকের ফরেনসিক অডিট ও অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ শেষ হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগও নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বেসরকারি ব্যাংক নিরীক্ষা ও একীভূতকরণের নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথে থাকলেও এক্ষেত্রে আলোচনার বাইরে থেকে গেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। যদিও ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকে লুণ্ঠন শুরু হয়েছিল। ২০১১ সালে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় তোলে জনতা ব্যাংকের বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা সামনে আসে ২০১২ সালে। এর এক বছর পরই আলোচনায় আসে বেসিক ব্যাংক লুণ্ঠনের ঘটনা। আওয়ামী লীগের আমলে একের পর এক বৃহৎ ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে দেড় লাখ কোটি টাকারও বেশি লোপাট করা হয়েছে। চলতি বছরের জুনে এসে কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ১০৭ কোটি টাকায়। একই সময়ে অগ্রণী ব্যাংকের ৩২ হাজার ২৫৭ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ২২ হাজার ১৮০ কোটি, সোনালী ব্যাংকের ১৯ হাজার ৮১৮ কোটি ও বেসিক ব্যাংকের ৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। খেলাপি হওয়া এসব ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। একদিকে উচ্চ খেলাপি ঋণ অন্যদিকে ধারাবাহিক লোকসানের প্রভাবে এ ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির পরিমাণও লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কেবল জনতা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তার কিয়দংশও সরকারি ব্যাংকের বিষয়ে নেয়া হয়নি। এ ব্যাংকগুলোর সংস্কার কেবল চেয়ারম্যান-এমডি পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের আড়ালে অর্থ তছরুফ ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে ফরেনসিক অডিটের মতো উদ্যোগ না নেয়ার কারণ জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের ওপর সবার অনেক প্রত্যাশা রয়েছে, সেটি আমরা বুঝি। কিন্তু একই সঙ্গে সে প্রত্যাশা বাস্তবভিত্তিক হওয়া উচিত। সরকারের সক্ষমতাও বিবেচনা করতে হবে। উত্তরাধিকার সূত্রে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে যে আমলাতন্ত্র পেয়েছি সেটি দিয়েই আমাদের কাজ চালিয়ে নিতে হচ্ছে। আমরা চাইলেই রাতারাতি সব আমলাকে বিদায় করে দিয়ে তাদের বিকল্প প্রতিস্থাপন করতে পারব না। অতীতে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয়ে যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে এরই মধ্যে বেশকিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অনেক প্রকল্প আমরা বাতিল করেছি। অনেক সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ব্যবস্থা নিচ্ছে। সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে সবকিছু শুধু অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। পরবর্তী সময়ে যারা রাজনৈতিক সরকারের দায়িত্বে আসবেন তাদেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি থাকা প্রয়োজন।’