Image description
 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ব্যালট পেপার ছাপানো নিয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর মন্তব্য ও প্রশাসনের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলে অভিযোগ এনেছেন বাগছাস– সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল।

বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার দিকে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের নিচে এক সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ তুলে ধরেন তিনি।

উজ্জ্বল বলেন, ভোটার ও প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের বেশ কয়েক দিন পর একটি প্যানেলের ভিপি প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের নজিরবিহীন ঘটনা এবং পরবর্তীতে আইনি নানা প্রক্রিয়া নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করে। সেই সঙ্গে ব্যালট পেপার ছাপানো নিয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রশাসনের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

উজ্জ্বল বলেন, আজ দীর্ঘ ৩৩ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বহুল প্রতীক্ষিত জাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর জাতির প্রত্যাশিত গণতান্ত্রিক রূপান্তরের যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি পুরো দেশবাসী এ নির্বাচন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আমাদের আশা ছিল সকলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু নির্বাচন আয়োজনে প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রমের শুরু থেকেই নানারকম অসংগতি লক্ষ্য করেছি আমরা। তফসিলে ঘোষিত মনোনয়নপত্র দাখিলের সবশেষ তারিখের আগের দিন গভীর রাতে একটি নির্দিষ্ট দলকে সুবিধা দিতে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় বাড়ায় নির্বাচন কমিশন। সেসময় থেকেই নির্বাচন আয়োজনে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ঘাটতি দেখা যায় এবং নির্বাচন আয়োজনে প্রশাসনের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়।

তিনি আরও বলেন, ডোপ টেস্টের নিয়ম রাখা হলেও আমরা এখনও জানি না সকল প্রার্থী ডোপ টেস্ট করিয়েছেন কি-না এবং নির্বাচনের দিন পার হয়ে গেলেও ডোপ টেস্টের ফলাফল এখনও পাওয়া যায়নি। যদি বিজয়ী কোন প্রার্থীর ডোপ টেস্টের ফলাফল পজিটিভ আসে তাহলে যে জটিলতা তৈরি হবে সে বিষয় সুরাহার সুনির্দিষ্ট কোন উপায় জানায়নি নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচনের আগের দিন রাতে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের উপস্থিতি নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে সন্দেহ তৈরি করে। পুলিশি পাহারা ছাড়া ভোট কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স নেয়ার ঘটনার ব্যাপারেও কোন সদুত্তর দিতে পারেনি কমিশন। ভোট কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট দেওয়ার জন্য আমাদের বারংবার আবেদনের পরও নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত দেয়নি। নির্বাচনের দিন ভোররাত ৩টায় ভোট কেন্দ্রে প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট দেয়ার সিদ্ধান্ত দেয় নির্বাচন কমিশন। এতো স্বল্প সময়ের নোটিশে পোলিং এজেন্টের ব্যবস্থা করা সকল প্রার্থীর জন্যই কঠিন কাজ ছিল। এর ফলে নির্দিষ্ট কোন পক্ষ অতিরিক্ত সুবিধা পেয়েছে বলে আমরা মনে করি। অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে নির্বাচনের দিন সকালে আমরা লক্ষ্য করি যে, পোলিং এজেন্ট দেয়ার সিদ্ধান্ত সকল রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানানো হয়নি। ফলে বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ শুরু হয় পোলিং এজেন্ট ছাড়া।

নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী ভোট গ্রহণের দিন কোন প্রচারণা চালানো নিষিদ্ধ হলেও, অধিকাংশ ভোট কেন্দ্রের ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে লিফলেট বিতরণ ও প্রচারণা চালাতে দেখা যায় ছাত্র শিবির ও ছাত্র দল সমর্থিত প্রার্থীদের। এর প্রতিবাদ করলে মব সৃষ্টি করে ছাত্র শিবির কর্মীরা এবং নিষ্ক্রিয় ভূমিকা রাখে কর্তৃপক্ষ।

ফজিলতুন্নেসা হল, তাজউদ্দিন হল, শহীদ রফিক-জব্বার হলসহ বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে পরিচয় নিশ্চিত না করেই প্রবেশ করেছে ভোটাররা। অধিকাংশ হলে ভোট প্রদান শেষে হাতে দেয়া হয়নি কোন অমোচনীয় কালি। যেসব জায়গায় দেয়া হয়েছে, সেসব কালিও সহজেই উঠে গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভোটার তালিকায় নামের পাশে ভোটারের ছবি ছিল না। কাজী নজরুল ইসলাম হল সংসদের ব্যালট পেপারে ৩ জনকে ভোট দেয়ার জায়গা থাকার কথা থাকলেও একজনকে মোট দেয়ার জায়গা ছিল। ফলে ব্যালট পেপারে লিখে ভোট দিতে হয়েছে। ভোটার উপস্থিতি তালিকায় টিক দেয়া কলমের পরিবর্তে পেন্সিল দিয়ে। ফলে একজন ব্যক্তির একাধিকবার ভোট দেয়ার সুযোগ ছিল এবং কেউ এই গ্রহণ করেছে কি-না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে শহীদ সালাম-বরকত হলে একজন ভোটারের ভোট অন্য কেউ আগেই প্রদান করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে কেন্দ্রগুলোতে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত ব্যালট পেপার দেয়ার ঘটনা। যদিও নির্বাচন কমিশন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কেবলমাত্র প্রয়োজন হলেই ভোটকেন্দ্রে অতিরিক্ত ব্যালট পেপার পাঠানো হবে। এসব ঘটনা প্রমাণ করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির বিন্দুমাত্র নির্বাচন কমিশনের ছিল না। সেই সাথে নারী হলগুলোতে প্রার্থী ও সাংবাদিকদের ঢুকতে না দেয়ার ঘটনা নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

নির্বাচনের সময় ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা আচরণবিধি লঙ্ঘন করে জোরপূর্বক ১৫নং ছাত্রী হলের ভোটকেন্দ্রে ঢুকে যায়। সেসময় সৃষ্ট হট্টগোলের ফলে ১ ঘণ্টা ভোট প্রদান বন্ধ থাকে এবং সাংবাদিকদের হল থেকে বের করে দেয়া হয়। শহীদ তাজউদ্দিন হলের ভোটকেন্দ্রে তারা একই কায়দা ঢুকতে গেলে হট্টগোলের সৃষ্টি হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্র শিবিরের সভাপতি নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলে প্রবেশ করেন। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করে ভোটারদের লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের টোকেন ও লিফলেট বিতরণ করে তাদের কর্মীরা। ছাত্রী হলগুলোতে লাইন জ্যামিং করে ভোটদানে ধীরগতি এবং ভোট প্রদানের পরও লাইনে দাঁড়িয়ে অন্যান্য ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা চালায় ছাত্রী সংস্থার কর্মীরা।

নির্বাচনের আগের রাতে শিবির ও তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন নানা ফেসবুক পেইজ থেকে ছাত্রদলের সাথে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আঁতাত হয়ে গেছে এবং আমাদের জিএস পদপ্রার্থী তৌহিদ সিয়াম ছাত্রদলের কাছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হয়। সারাদিন ধরে ছাত্রদল ও বামপন্থী সংগঠনগুলোকে জড়িয়ে বাগছাস ও তৌহিদ সিয়ামকে নিয়ে তাদের এ প্রপাগান্ডা অব্যাহত থাকে। আগের রাতে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা ছড়ানো ছাত্রশিবিরই এখন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। এটা প্রমাণ করে এসব প্রপাগান্ডা ছিল নির্বাচনকে প্রভাবিত করার অপপ্রয়াস। আমরা সকল পক্ষের মধ্যে সুস্থ ও সহনশীল গণতান্ত্রিক চর্চার পক্ষে এবং এ ধরনের অসৎ রাজনীতির নিন্দা জানাই।

সামগ্রিকভাবে, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে প্রশাসনের সদিচ্ছা ও প্রস্তুতির অভাব ছিল। মনে হয়েছে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও নির্বাচন আয়োজন করতে বাধ্য হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এবং তাদের এই প্রস্তুতির অভাবের সুবিধা নিয়েছে একটি পক্ষ। এবং আরেকটি পক্ষের মধ্যে পেশিশক্তির জোরে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা আমরা দেখেছি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার জন্যই আমরা জাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিলাম। অতীতে নির্বাচনের তারিখ ও তফসিল ঘোষণার পরও একাধিকবার নির্বাচন আয়োজনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এবার আমরা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। আমরা আরও জানাতে চাই যে, জাকসু নির্বাচন না হওয়ার পেছনে শিক্ষক রাজনীতির ভূমিকা অতীতেও ছিল এবং এবারও তা জাকসু নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। তবে, এতো প্রতিকূলতা অতিক্রম করেও নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের ভোট প্রদান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে তাদের আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ।

তিনি বলেন, অসংখ্য অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা, প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এবং প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হওয়ার পরও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার স্বার্থে ব্যর্থ নির্বাচন কমিশনের সমন্বয়হীনতা, অদক্ষতা এবং আন্তরিকতা ও প্রস্তুতির অভাবের তীব্র নিন্দা জানাই। আমরা মনে করি, এই নির্বাচন বিতর্কিত হওয়ার সকল দায়ভার নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকেই নিতে হবে।