
রাজধানীতে এক্সিম ব্যাংকের কয়েকটি শাখা ঘুরে দেখা যায়, গ্রাহকরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরেও টাকা উত্তোলন করতে পারছেন না। কেউ কেউ এক শাখায় টাকা না পেয়ে ছুটছেন অন্য শাখায়, সেখানে গিয়েও দেখছেন একই চিত্র। অনেক দেনদরবারের পর একজন গ্রাহক সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত উত্তোলন করতে পারছেন
নিজের কষ্টার্জিত জমানো অর্থই এখন কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইসলামী ধারার এক্সিম ব্যাংকের গ্রাহকদের। গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকটি। আর আমানত ফেরত না পেয়ে হতাশ লাখ লাখ গ্রাহক। সংশ্লিষ্ট শাখায় এসে দীর্ঘ অপেক্ষার পর অনেকটা শূন্য হাতে ফেরত যাচ্ছেন আমানতকারীরা। এক্সিম ব্যাংকের কয়েকটি শাখায় ঘুরে এবং খবর নিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। টাকা উত্তোলন করতে আসা কয়েকজন গ্রাহক জানান, নিজের টাকাই এখন কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জমাকৃত টাকা না পারছি প্রয়োজনমাপিক উত্তোলন করতে, না পারছি দাবি ছেড়ে দিতে। অনেক দেনদরবার করার পর একজন গ্রাহক সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত পাচ্ছেন, যদিও একাউন্টে জমা আছে লাখ লাখ টাকা। ১০ হাজার টাকায় তার কোনো প্রয়োজনই মিটছে না। তাও সবাই যে পাচ্ছেন তা নয়। অধিকাংশ গ্রাহককেই খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে।
রাজধানীতে এক্সিম ব্যাংকের কয়েকটি শাখা ঘুরে দেখা যায়, গ্রাহকরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরেও টাকা উত্তোলন করতে পারছেন না। কেউ কেউ এক শাখায় টাকা না পেয়ে ছুটছেন অন্য শাখায়, সেখানে গিয়েও দেখছেন একই চিত্র। অনেক দেনদরবারের পর একজন গ্রাহক সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত উত্তোলন করতে পারছেন।
জানতে চাইলে, টাকা উত্তোলন করতে আসা ইসমাইল হোসেন নামের একজন গ্রাহক শীর্ষনিউজ ডটকমকে বলেন, ৫০ হাজার টাকার চেক নিয়ে দুই দিন যাবত ঘুরছি। টাকার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিক মতো পরিচালনা করতে পারছি না। ১০ হাজার টাকার বেশি এক টাকাও দেয় না ব্যাংক। রফিকুল নামে আরেকজন গ্রাহক বলেন, দনিয়া শাখায় টাকা না পেয়ে আসলাম মতিঝিল শাখায়, এখানেও একই চিত্র। অনেক দেনদরবার করেও টাকা পাচ্ছিন া।
তিনি আরও বলেন, ৮০ হাজার টাকার চেক নিয়ে এসেছি। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এতো টাকা দেওয়া যাবে না। অনেক অনুনয়-বিনয় করার পর ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি হয়েছেন। অথচ আমার এখন টাকার খুব দরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যাংকটির সারা দেশের চিত্র একই। এদিকে টাকা না পেয়ে ব্যাংকটির প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন গ্রাহকরা। যার ফলে নতুন করে তেমন কোন ডিপোজিটও হচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংক গ্রাহকের আস্থা ধরে রাখতে না পারলে নতুন কোন ডিপোজিটর পাবে না। গ্রাহকের আস্থা ধরে রাখতে লেনদেন নিয়মিত থাকা উচিত। মানুষ ঠিকমতো টাকা পাচ্ছে না এটা ব্যাংক খাতের জন্য সুখকর নয়।
পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সীমাহীন লুটপাট আর অনিয়মে স্থবির হয়ে পড়ে সামগ্রিক অর্থনীতি। নামে-বেনামে নিয়মবহির্ভুত ঋণ অনুমোদন দিয়ে ব্যাংকগুলোকে করা হয় ফতুর। এই লুটপাট থেকে মুক্তি পায়নি ইসলামী ধারার এক্সিম ব্যাংকও। অব্যাহত লুটপাটের ফলে ব্যাংকটির অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মোটা অংকের তারল্য সহায়তা দেওয়ার পরেও কোমড় সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি ব্যাংকটি।
পতিত আওয়ামী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘অর্থ যোগানদাতা’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। ২০০৭ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা ১৭ বছর হাসিনার প্রত্যক্ষ মদদে তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে বহাল থাকেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাংকগুলোতে তিনি অঘোষিত কর্তৃত্ব চালান। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আলোচিত এই শিল্পপতি গ্রেফতার হয়েছেন। আর ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিকটাত্মীয় নজরুল ইসলাম স্বপন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এক্সিম ব্যাংকে বর্তমানে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ৯১০ কোটি টাকা। অভ্যুত্থানের পর ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা নিয়েছে। ১৫৫ শাখার ব্যাংকটি বিগত বছরে একীভূত হতে যাওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ৪০৯ কোটি টাকা লোকসানে পড়েছে। এছাড়া পুঁজিবাজারেও আশংকাজনক হারে কমেছে ব্যাংকটির শেয়ারদর।
তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক পর্যন্ত এক্সিম ব্যাংক তাদের মোট খেলাপির পরিমাণ দেখায় ৩ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। অথচ একই সময়ের একিউআর প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকটির খেলাপির পরিমাণ ২৫ হাজার ১০১ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ। এমনকি এই খেলাপি ডিসেম্বর নাগাদ ৫১ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলেও মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
মূলত সীমাহীন লুটপাটের কারণে তারল্য সংকটে পড়ে ব্যাংকটি। যার ফলে গ্রাহকের পাওনাও পরিশোধ করতে পারছে না। জানতে চাওয়া হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক্সিম ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা শীর্ষনিউজ ডটকমকে বলেন, ব্যাংকে টাকার সংকট রয়েছে। তাই গ্রাহকের চাহিদা মোতাবেক টাকা দেওয়া যাচ্ছে না। এজন্য প্রায়ই গ্রাহকদের কটু কথা শুনতে হয়।
ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে লুটপাট হওয়া ৫টি দুর্বল ব্যাংক একীভূত করে একটি শক্তিশালী ব্যাংক গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শেষে সম্প্রতি ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স পাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সবশেষে গভর্নর ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণের ঘোষণা দিলে অন্য ব্যাংকগুলো মেনে নিলেও রহস্যজনক কারণে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন দ্বিমত পোষণ করেন।
তিনি একীভূত না হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আরও দুই বছর সময় চান। গেল ৩১ আগস্ট শরিয়াহভিতিক পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের একীভূত করার বিষয়ে শুনানির প্রথম দিনে বাংলাদেশ ব্যাংকে আসে এক্সিম ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। পরে সাংবাদিকদের এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, দুই বছর সময় পেলে এক্সিম ঘুরে দাঁড়াবে।
এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন বলেন, ‘একীভূত হওয়ার কথা উঠার কারণে এখন আর কোনো ডিপোজিট হয় না। ডিপোজিট না হওয়ায় ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। যার যতটুকু আছে সেটা দিয়ে প্রচণ্ড কাজ করছি, সবাই চেষ্টা করছি। যতটুকু পারি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংকটির প্রকৃত তথ্য গোপন করে মাত্র ৩ শতাংশ এডভান্স ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) দেখানো হয়। ৫ আগস্টের পর বেরিয়ে আসে আসল চিত্র। ব্যাংকটির আমানত ৩৮ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকার বিপরীতে ৫৩ হাজার ৩১৭ কোটি বিনিয়োগ রয়েছে। সে হিসেবে ব্যাংকটির এডিআর রেশিও ১৩৭ শতাংশের বেশি। আওয়ামী সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে এক্সিম ব্যাংকের এই অনিয়ম চলতে থাকে বছরের পর বছর।
এসব বিষয়ে জানতে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপনকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. আরিফ হোসেন খান শীর্ষনিউজ ডটকমকে বলেন, এক্সিম ব্যাংক একীভূত হতে চায়না। এর জন্য তারা যে বক্তব্য দিচ্ছে, সেগুলোর স্বপক্ষে বাস্তবে তাদের কি আছে তা উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে। এরপর সেগুলো ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।