নানা সংকটে বন্ধ হচ্ছে কারখানা। বেকার হচ্ছে কর্মক্ষম শ্রমিক। কাজের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসছে কর্মহীন শ্রমিকরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছয় মাসে বন্ধ হয়েছে তৈরি পোশাক খাতের ১০০টির বেশি কারখানা। কয়েক মাসে ১০টির মতো টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়েছে। গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ৮৩টি কোম্পানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। সিমেন্ট, ইস্পাত ও কাগজ শিল্পের অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে। ছয় মাসে প্রায় ১০ লাখ কর্মক্ষম শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন বলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যে জানা গেছে। জরুরি কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা না গেলে ‘সামাজিক অস্থিরতা’ ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শ্রম খাতের সংকট মেকাবিলায় ছয় উপদেষ্টাকে নিয়ে কমিটি হয়েছে। বেকার শ্রমিকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে বিজিএমইএর পাশাপাশি ইপিজেড, বেজা, বেপজা কর্তৃপক্ষকেও অনুরোধ জানানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কয়েকটি শিল্প কারখানায় হামলা শুরু হয়। এরপর শুরু হয় শ্রম-অসন্তোষ। বন্ধ হতে থাকে কারখানা। বিক্ষোভ কমে যাওয়ার পর কিছু কারখানা চালু হলেও গ্যাস, বিদ্যুৎ, মূলধন ও ডলার সংকট, কাঁচামালের অপর্যাপ্ততা, পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়াসহ নানা কারণে স্থায়ীভাবে কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, চলতি মাসে বেশ কয়েকটি শিল্পকারখানা বন্ধে কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছেন। গত ২ জানুয়ারি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ীর জরুন এলাকায় কেয়া গ্রুপের চারটি তৈরি পোশাক কারখানা (১ মে থেকে) স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এক সপ্তাহ পর ৯ জানুয়ারি একই জেলার প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী পলিকন লিমিটেড অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর আগে ৩ নভেম্বর গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ীতে তুসুকা গ্রুপের ছয়টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি রাজনৈতিক কারণেও দেশের বেশ কয়েকটি বড় শিল্প গ্রুপের কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো কোম্পানির মালিক গ্রেপ্তার হয়েছেন কিংবা রাজনৈতিক কারণে মালিক পালিয়ে যাওয়ার কারণে বেক্সিমকো, এস আলমের মতো বড় শিল্পকারখানাগুলো বন্ধ হয়েছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের কারখানা বন্ধ হওয়ায় গতকাল গাজীপুর মহানগরীর সারাব এলাকায় মানববন্ধন করেছেন কয়েক হাজার শ্রমিক। কারখানাটির শ্রমিক মোস্তাফিজুর রহমান মানববন্ধন থেকে সাংবাদিকদের জানান, প্রায় এক মাস ধরে তারা কর্মহীন। তারা কাজ করতে চান। কারখানা খুলে দিলে তারা আগের কাজে ফিরে যাবেন। এজন্য তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছেন। গত ১৫ ডিসেম্বর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বেক্সিমকোর শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের কমিটির সভায় ১৬টি কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মালিকপক্ষ সরকারকে জানিয়েছে, শুধু বেক্সিমকো গ্রুপের কারখানা বন্ধে ৪০ হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন।
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর কী পরিমাণ কর্মক্ষম শ্রমিক বেকার হয়েছেন- এ তথ্য জানতে চাইলে বিলসের নির্বাহী পরিচালক ও অন্তর্বর্তী সরকারের শ্রম খাত সংস্কার কমিশনের আহ্বায়ক সৈয়দ সুলতান আহমেদ জানান, বেকার হয়ে যাওয়া শ্রমিকের প্রকৃত সংখ্যা কারও কাছে নেই। গণমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে, তাতে কয়েক মাসে প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন।
বেকার হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে বেশ কিছু প্রস্তাব সরকারকে দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে বিলসের নির্বাহী পরিচালক জানান, বিভিন্ন সময় সরকারের সঙ্গে আলোচনায় আমরা তিনটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছি। এক) যারা কারখানা চালু রাখতে পারবেন, তাদের সহায়তা করা যেন শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিশ্চিত করা যায়; ২) যেসব মালিক পালিয়েছেন, তাদের কারখানাগুলোতে প্রয়োজনে প্রশাসক নিয়োগ করে কারখানা চালু রাখার উদ্যোগ নেওয়া এবং ৩) কর্মহীন শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়িয়ে নতুন কারখানায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেওয়া। এভাবে অন্তত ৫ লাখ কর্মহীন শ্রমিকের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব বলে মনে করেন শ্রম খাতবিষয়ক সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক।