Image description
ঢাকা-টঙ্গী ৩য় ও ৪র্থ রেললাইন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধান বাধা-রেলের প্রকল্প পরিচালক

আওয়ামী লীগ শাসনামলের গত ১৫ বছরে রেলের ৯৮টি উন্নয়ন প্রকল্প সমাপ্ত হয়। যার মধ্যে এমন কোনো প্রকল্প নেই যেখানে সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে লুটপাট করা হয়নি। ২০১২ সালের ঢাকা-টঙ্গী ৩য় ও ৪র্থ লেন ১৭ বছরে সমাপ্ত হবে কী না তা অনিশ্চিত। ৩ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের ব্যয় ছিল প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।

পরবর্তীতে সময়ের সঙ্গে ব্যয় বাড়িয়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকায় ঠেকানো হয়েছে। ৩য় ও ৪র্থ লেন প্রকল্পটি সমাপ্ত হলে কমলাপুর থেকে মাত্র ৩-৪ মিনিট পর পর ট্রেন ছাড়া সম্ভব হতো। এতে কমলাপুর রেলস্টেশন ও টঙ্গীতে ট্রেনের জট কমে যেত। প্রকল্পটি যথাসময়ে বাস্তবায়নে আরেকটি বড় বাধা হলো রেললাইনের উপর দিয়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ। সেখানে শত শত পিলার গাঁথা হয়েছে। ইচ্ছা করলেই এই পথে ৩য় ও ৪র্থ লেনের পর আর কোনো লাইন স্থাপন করা সম্ভব হবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেললাইনের উপর দিয়ে নির্মিত এক্সপ্রেসওয়েতে যে পরিমাণ যাত্রী চলাচল করবে, এর প্রায় ১০ গুণ মানুষ রেলপথে চলাচল করতে পারত যদি নিচে রেললাইন সম্প্রসারণ করা হতো।

রাজধানীর কাওলা থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত রেললাইনের উপর দিয়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ চলছে। রেলের জমির উপর দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ প্রায় শেষের দিকে। আর ৩য় ও ৪র্থ লেনের কাজ ৫৬ শতাংশের ঘরে। প্রকল্পটি কবে নাগাদ শেষ হবে, তা নিশ্চিত নয়। বলা হচ্ছে, ২০২৭ সালের জুলাইয়ের দিকে শেষ হবে। প্রকল্প শুরুর দিকে ২০১২ সালেও বলা হয়েছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে এ প্রকল্প সমাপ্ত হবে। প্রকল্প শেষ হলে ৩-৪ মিনিট পর পর কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেন চালানো হবে। এখনও সেই স্বপ্ন অধরা। অতি দুর্বল পরিকল্পনা, অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত ও লুটপাটের আশায় নেওয়া এই প্রকল্প সমাপ্ত না হওয়ায় এর সুফলও পাচ্ছে না রেল। তবে রেলই বলছে, তাদের জমির ওপর দিয়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য রেলের এই প্রকল্পের এমন দশা।

গত তিন দিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রেলের জমির উপর দিয়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বীরদর্পে এগোচ্ছে। প্রকল্পের সরঞ্জাম, পিলার নির্মাণের চলমান কাজসহ পুরো রেলপথকে যেন জিম্মি করে রাখা হয়েছে। কাওলা থেকে রেললাইনের প্রায় শতভাগ জমির উপর দিয়ে নির্মিত এক্সপ্রেসওয়ের কাজ পুরোদমে চলছে। নিরুপায় রেল। এ পথে নামেমাত্র গতি নিয়ে ট্রেন চলছে। এক্সপ্রেসওয়ের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মালামাল-সরঞ্জামের জন্য ইতোপূর্বে বেশ কয়েকবার ট্রেন লাইনচ্যুতসহ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। রেল নিশ্চুপ। ট্রেন এবং সাধারণ যাত্রীরা চলছে চরম ঝুঁকি নিয়ে। এ পথের বেশ কয়েকটি রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজারের ভাষ্য, ব্যর্থতার তালিকা করলে সারা দেশের নিরিখে শীর্ষে রাখতে হবে রেলকে। কেননা, দেশজুড়ে যথাসময়ে প্রকল্প শেষ করতে না-পারার ব্যর্থতায় তারাই প্রথম। আর ওই সব প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতার মূল কারণই হলো সাবেক রেলপথমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) কার্যালয়সহ রেলওয়ে-সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতি। প্রকল্প জিইয়ে রাখা মানেই ব্যয় বাড়ানো। আর ব্যয় বাড়লে লুটপাটও বাড়ে।

টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর-ভৈরব পর্যন্ত ডাবল লাইন রয়েছে। রেলের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল থেকে আসা অধিকাংশ ট্রেন বিমানবন্দর-কমলাপুর স্টেশনের সিগন্যাল পেতে টঙ্গী স্টেশন আউটারে দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়। রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তরের সূত্র জানায়, এ এলাকায় ট্রেনের জটলা বাধিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণে ব্যস্ত ছিল। গুরুত্বপূর্ণ ৩য় ও ৪র্থ লেন প্রকল্পটি সমাপ্ত হোক-আ.লীগ সরকার তা চায়নি। নতুন প্রকল্প, নতুন রেলপথ নির্মাণে ওৎপেতে থাকতেন রেলপথমন্ত্রী, সচিব, রেলওয়ের পিডিসহ খোদ শেখ হাসিনা। লাইন তৈরির স্বার্থে এ পথে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে দেওয়া হতো না। তেজগাঁও রেলওয়ে জংশন এলাকায় ট্রাকস্ট্যান্ড, খিলগাঁও রেললাইন এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ অবৈধ স্থাপনা, টঙ্গী স্টেশন এলাকায় কলোনিসহ পুরো প্রকল্পের দুইপাশে দখলকৃত রেলের জমি উদ্ধার করা যায়নি।

ঢাকা-টঙ্গীর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ট্রেন চলাচলে বিলম্ব যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ‘টঙ্গীতে ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকে সিগন্যালের আশায়। কিন্তু অপরদিকে প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চলমান ঢাকা-যশোর প্রকল্প (যতটুকু সমাপ্ত হয়েছে) অলস পড়ে থাকছে। ওই পথে ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ৪টি ট্রেন চলাচল করছে। ঢাকা-টঙ্গীর মধ্যে ৩য় ও ৪র্থ লেন সমাপ্ত হলে এ পথে আরও প্রায় ২৫০টি ট্রেন চালানো সম্ভব ছিল।

রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ প্রকল্পের সঙ্গে কমলাপুর স্টেশনের ভেতর কমপক্ষে ১২টি নতুন লাইন স্থাপন করার কথা। যাতে ৩ থেকে ৪ মিনিটের মধ্যে স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়া ও স্টেশনে প্রবেশ করানো যায়। ঢাকা-টঙ্গী রুটে মাত্র ২টি লাইন থাকায় যুগের পর যুগ ট্রেন যথাযথভাবে ছাড়া ও প্রবেশ করানো যাচ্ছে না। একেকটি ট্রেন ছাড়তে কখনও কখনও দেড় ঘণ্টাও অপেক্ষা করতে হয়। স্টেশন থেকে ছাড়া ট্রেন বিমানবন্দর কিংবা টঙ্গী গিয়ে পৌঁছলে অন্য একটি ট্রেন ছাড়তে হচ্ছে। সিডিউল বিপর্যয় হলে ৪ থেকে ৭ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে ট্রেন চলাচল করে।

প্রকল্পের পরিচালক নাজনীন আরা কেয়া যুগান্তরকে বলেন, এ প্রকল্পের শুরু থেকে পদে পদে বাধা ছিল। এত বছরেও প্রকল্প এলাকায় উচ্ছেদ ও অবৈধ দখলদার মুক্ত করা যায়নি। তাছাড়া রেললাইনের ওপর দিয়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ তো আছেই। রেলের এ প্রকল্প বাস্তবায়নে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ অন্যতম প্রধান বাধা। এক্সপ্রেসওয়ের কারণে বেশ কয়েকবছর কাজই শুরু করা যায়নি। নকশা পরিবর্তনসহ নানান জটিলতা এ প্রকল্প ঘিরে ছিল। গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি ২০২৭ সালে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। আমরা পুরোদমে কাজ শুরু করতে চাই।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক যুগান্তরকে বলেন, রেলের উন্নয়ন ঘিরে ছিল ব্যাপক লুটপাট। গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই ও বিস্তারিত নকশা ছাড়াই গ্রহণ করা হয়। ঢাকা-টঙ্গী পর্যন্ত ১০ থেকে ১২টি রেলপথের প্রয়োজন বর্তমানে রয়েছে। ৩-৪ মিনিট পর পর ট্রেন পরিচালনা করতে হলে ওই পরিমাণ লাইন প্রয়োজন। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রায় ৯০ শতাংশই চলমান রেলপথের উপরে করা হয়েছে। শত শত পিলার গাঁথা হয়েছে। ইচ্ছা করলেই এ পথে ৩য় ও ৪র্থ লেনের পর আরও কোনো লাইন স্থাপন করা সম্ভব হবে না। কিন্তু রেললাইন সম্প্রসারণ করা সম্ভব হলে এক্সপ্রেসওয়ের চেয়ে ১০ গুণ বেশি যাত্রী রেলপথে চলাচল করতে পারত।

রেলওয়ে উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান যুগান্তরকে বলেন, ৩য় ও ৪র্থ লেন খুবই জরুরি। এর নির্মাণ কাজ বছরের পর বছর ধরে চলছে। এমনটা হতে পারে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে রেলের যথাযথ উন্নয়নে প্রকল্প যাচাই-বাচাই করছে। কিছু প্রকল্প বাতিলও করা হয়েছে। সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে করা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্তদের জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে।