Image description

উড়োজাহাজের নিরাপদ ওঠানামার জন্য বিমানবন্দরের রানওয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা জরুরি। হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এ কাজে তেমন নজর নেই কর্তৃপক্ষের। রানওয়ে পরিষ্কারের জন্য তিনটি সুইপার গাড়ির সব অকেজো। এর মধ্যে দুটি প্রায় ১০ বছর আগে নষ্ট হয়েছে। আরেকটি অচল হয় দুই বছরের বেশি সময় আগে। তখন থেকেই ‘ঝাড়ুথেরাপি’র মাধ্যমে চলছে রানওয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ। অর্থাৎ-উপায় না থাকায় ম্যানুয়ালি ঝাড়ু দিয়ে রানওয়ে পরিষ্কারের কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরের রানওয়ে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর শাহজালালের তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম জরুরিভিত্তিতে দুটি অত্যাধুনিক সুইপার গাড়ি কিনতে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (বেবিচক) চিঠি দেন। তবে তা আজ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। এ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথাও নেই। এমন পরিস্থিতির কথা জানিয়ে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অরগানাইজেশনকে (আইকাও) চিঠি দিলেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। রানওয়ের চলমান পরিস্থিতিকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে তারা বলছেন, একটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০-ইআর এয়ারক্রাফটের দাম ১২শ থেকে ১৫শ কোটি টাকা। শাহজালালের ঝুঁকিপূর্ণ রানওয়ের কারণে যদি কোনো এয়ারক্রাফট দুর্ঘটনায় পড়ে সেজন্য সিভিল এভিয়েশন দায়ী থাকবে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা জানান, নিয়ম হলো-বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের পর দ্রুতগামী সুইপার গাড়ির মাধ্যমে রানওয়ে পরিষ্কার করা। এছাড়া সপ্তাহে অন্তত ২ বার ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ রেখে রানওয়ে ক্লিন করতে হয়। কারণ বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের পর রানওয়েতে নুড়ি পাথর তৈরি হয়। পাশাপাশি অনেক সময় বিমানের অনেক পার্টস, ধ্বংসাবশেষ (এফওডি) এবং ক্ষতিকর বস্তু রানওয়েতে পড়তে পারে। যেগুলো উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় চরম ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।

জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সদস্য (অপারেশনস) এয়ার কমোডর আবু সাঈদ মেহেবুব খান যুগান্তরকে বলেন, ‘সুইপার গাড়িগুলো অকেজো হয়ে গেছে কিনা, সেটা এই মুহূর্তে আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। খোঁজ নিয়ে জানাতে হবে।’ আর তা জানতে এ প্রতিবেদককে সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে যোগাযোগের পরামর্শও দেন। সুইপার গাড়ির অভাবে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করার বিষয়টি আপনি জানেন কিনা-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কোনো তথ্য আমার জানা নেই। আপনার কাছ থেকেই এটা প্রথম শুনলাম।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, আইকাওর রুলস অনুযায়ী বিমানবন্দরের রানওয়ে নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। বিমানবন্দরের ক্যাটাগরি আপডেট করারও বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কারণ প্রতিটি উড্ডয়ন-অবতরণের পর রানওয়েতে ধ্বংসাবশেষ, রাবার ঘর্ষণ, বালি, নুড়ি পাথর বা আলগা জিনিস জমা হয়। এছাড়া অ্যাপ্রোন ও ট্যাক্সিওয়েতে পাথর, তেল, ক্যান, বোতল, পেরেক, প্লাস্টিক ব্যাগ, সুটকেসের চাকা, হাতল, তালা ও লাগেজ ট্যাগ পড়ে থাকে। সাধারণত এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিনগুলো চলমান অবস্থায় সহজেই মাটিতে পড়ে থাকা এসব আলগা উপাদান শোষণ করতে পারে। এতে ইঞ্জিনের প্রপেলার বা কম্প্রেসার ব্লেডের মারাত্মক ক্ষতি হয়। উড়ন্ত অবস্থায় মাঝ আকাশে প্রপেলার বা জেট ইঞ্জিন বিস্ফোরণের ঝুঁকিও থাকে এসব বস্তুর কারণে।

জানা গেছে, বর্তমানে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সুইপাররা ঝাড়ু দিয়ে রানওয়ে ও আশপাশের এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখছেন। কিন্তু এতবড় রানওয়েকে ম্যানুয়ালি ঝাড়ু দিয়ে সচল রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া ঝাড়ু দিয়ে অনেক এফওডি ক্লিন করাও অসম্ভব। উলটো এটি আরও বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।

বিমানবন্দরের রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, অ্যাপ্রোন ও কার্গো ভিলেজ এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে আগে তিনটি রানওয়ে সুইপার গাড়ি ছিল। এর মধ্যে রানওয়ে সুইপার এলজিন (মডেল নং-০৮২৫কে) ২০০৬ সালের ১৬ মার্চ কেনা হয়। ১০ বছর চলার পর ২০১৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে এটি পুরোপুরি অকেজো। একই বছরের ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্লোয়ার বেজড রানওয়ের দ্বিতীয় সুইপার গাড়ি (মডেল নং-সিআর-৪৫০ডি) ক্রয় করা হয়। মাত্র ৮ মাস যেতে না যেতে সেটি পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। জোড়াতালি ও স্পেয়ার পার্টস দিয়েও সেটা আর সচল করা সম্ভব হয়নি। ২০১৫ সালে ইতালি থেকে তৃতীয় রানওয়ে সুইপার গাড়িটি কেনা হয়। অভিযোগ আছে-ক্রয়ের পর থেকেই গাড়িটি বেশির ভাগ সময় নষ্ট থাকত। এটি সচল রাখতে মাসে লাখ লাখ টাকা খরচ করা হয়। টানা চলার কারণে এই গাড়িটিও এক সময় অচল হয়ে পড়ে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বছর দুয়েক আগে দুটি সুইপার গাড়ি কেনার উদ্যোগও নেওয়া হয়। কয়েক দফা ফাইল চালাচালিও হয়ে। এখন বেবিচকের একজন সদস্যের দপ্তরে লালফিতায় ফাইলটি বন্দি হয়ে আছে। অভিযোগ আছে-কমিশন বাণিজ্য পাকাপোক্ত না হওয়ায় গাড়ি দুটি কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে কারও আগ্রহ নেই।

সংশ্লিষ্টরা জানান, শাহজালালের থার্ড টার্মিনালের একটি অংশের অপারেশনাল কার্যক্রম চালুর প্রক্রিয়া চলছে। থার্ড টার্মিনাল চালু হলে বিমানবন্দরের আয়তন দ্বিগুণ হবে। এ অবস্থায় বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণে যে কোনো সময় বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

বিমানের একজন পাইলট জানান, রানওয়ে পরিষ্কারের কাজটি খুবই টেকনিক্যাল ও দুরূহ। একটি এয়ারক্রাফট যখন রানওয়েতে অবতরণ করে তখন তার প্রতিটি টায়ার রানওয়েতে ১.৫ পাউন্ড পর্যন্ত কালো রাবার ছেড়ে দেয়। একটি এয়ারবাসের (এ-৩৮০) ২২টি চাকা থাকে। অবতরণের সময় ঘর্ষণে এসব চাকার রাবার রানওয়ের পৃষ্ঠকে কালো ও মসৃণ করে তোলে। রানওয়েতে থাকা বিভিন্ন লাইনের সাদা বা বিভিন্ন কালারের দাগগুলোকে ঢেকে দেয়, যা একটি ফ্লাইটের নিরাপদ অবতরণের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করে। এসব রাবার ম্যানুয়ালি ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা অসম্ভব। গরম পানি স্প্রে করে সুইপার গাড়ি দিয়ে সেগুলো পরিষ্কার করতে হয়। জানতে চাইলে হযরত শাহজালাল (রহ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এসএম রাগীব সামাদ যুগান্তরকে বলেন, ‘মাঝে মধ্যে ম্যানওয়ালি পরিষ্কার করা হয়।’ ম্যানুয়ালি পরিষ্কার কি ঝাড়ু দিয়ে করা হয়-এই প্রশ্ন করতেই তিনি এ প্রতিবেদককে লিখিত প্রশ্ন পাঠাতে বলেন। পরে লিখিত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ম্যানুয়ালি ঝাড়ু দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিদিন ন্যূনতম তিন বার ইন্সপেকশন গাড়ি দিয়ে রানওয়ে ও অ্যাপ্রোন পরিদর্শন করা হয় এবং চাহিদার ভিত্তিতে রানওয়ে সুইপ করা হয়। তিনটির মধ্যে একটি সুইপার গাড়ি সচল আছে। ওটা দিয়েই কাজ চলছে। আরও দুটি সুইপার গাড়ি কেনার প্রক্রিয়া বেবিচক সদর দপ্তর কর্তৃক প্রক্রিয়াধীন আছে।’