Image description
 

আগামী সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের জন্য ৬০টি জিপ গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) জন্য কেনা হবে ১৯৫টি জিপ গাড়ি।

মন্ত্রী ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্য একই ধরনের জিপ গাড়ি কেনা হবে। দরপত্র ছাড়াই সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে গাড়িগুলো কিনতে ব্যয় হবে ৪৩১ কোটি ৮৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা। প্রতিটি গাড়ির দাম ধরা হয়েছে ১ কোটি ৬৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।

আগামী সরকারের মন্ত্রী ও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা ইউএনওদের জন্য এসব গাড়ি কেনার পাশাপাশি বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্মরত সিনিয়র সহকারী কমিশনার, সহকারী কমিশনারদের জন্য ২৫টি মাইক্রোবাস কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্মরত সিনিয়র সহকারী কমিশনার, সহকারী কমিশনাররা বিভিন্ন পরিদর্শন, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, বাজার মনিটরিং, ত্রাণ বিতরণের কাজে এ মাইক্রোবাসগুলো ব্যবহার করবেন।

 

প্রতিটি মাইক্রোবাসের দাম ধরা হয়েছে ৫২ লাখ টাকা। এতে ২৫টি মাইক্রোবাস কিনতে মোট ১৩ কোটি টাকা লাগবে। এ হিসাবে ২৫৫টি জিপ গাড়ি এবং ২৫টি মাইক্রোবাস কিনতে মোট খরচ হবে ৪৪৪ কোটি ৮৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি এসব গাড়ি কেনার অনুমোদন দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। কয়েকটি শর্তে এ অর্থ ব্যয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।

সূত্র জানায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিবহন শাখা থেকে ১৯ আগস্ট এসব গাড়ি কেনার সম্মতি চেয়ে অর্থ বিভাগের সচিব বরাবর চিঠি পাঠানো হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ বিভাগ থেকে এসব গাড়ি কেনার অর্থ ব্যয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড থেকে এসব গাড়ি কেনা হবে। মন্ত্রী ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্য কেনা হবে ‘মিতসুবিশি পাজেরো’ (কিউএক্স-২৪২৭ সিসি)।

আগামী সরকারের মন্ত্রীদের জন্য জিপ গাড়ি কেনার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, উপদেষ্টা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সমপদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ব্যবহারের জন্য সরকারি পরিবহন পুলে যথাযথ মানের গাড়ি বর্তমানে নেই। বর্তমানে উপদেষ্টাদের সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর যে গাড়ি (কার) সরবরাহ করেছে, সেগুলো ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কেনা। গাড়িগুলোর আয়ুষ্কাল ইতোমধ্যে ৯ বছরের বেশি অতিক্রান্ত হয়েছে। এ গাড়িগুলো প্রায়শই মেরামত করতে হয়, যা ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। বিদ্যমান গাড়িগুলো দিয়ে ভবিষ্যতে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীদের পক্ষে তাদের নির্বাচিত এলাকা সফর, উন্নয়ন প্রকল্প পরিদর্শনসহ অন্য জরুরি কাজ করা কষ্টসাধ্য হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রীদের জন্য ৬০টি জিপ গাড়ি কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্য জিপ গাড়ি কেনার বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, মোবাইল কোর্ট পরিচালনার পাশাপাশি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য মাঠপর্যায়ে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অন্য কাজ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। এছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারাই সাধারণত সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। সে বিবেচনায় সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ করা গাড়িগুলোর মধ্যে ১৯৫টি গাড়ি প্রতিস্থাপনের লক্ষ্যে নতুন জিপ গাড়ি কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

কমিশনারদের মাইক্রোবাস কেনার বিষয়ে বলা হয়েছে, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্মরত সিনিয়র সহকারী কমিশনার, সহকারী কমিশনাররা নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে বিভিন্ন পরিদর্শন, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, বাজার মনিটরিং, ত্রাণ বিতরণ ইত্যাদি কাজ করেন। এছাড়া আগামী ফেব্রুয়ারিতে (২০২৬ সাল) অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অন্য দায়িত্ব পালনের জন্য মাইক্রোবাস প্রয়োজন হবে। এজন্য বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়গুলোতে বর্তমানে ব্যবহৃত ৭২টি মাইক্রোবাসের মধ্যে ২৫টি মাইক্রোবাস প্রতিস্থাপনের লক্ষ্যে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর নতুন মাইক্রোবাস কেনার প্রস্তাব করেছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ বিভাগকে জনানো হয়, সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর থেকে ২৮০টি গাড়ি কিনতে ব্যয় হবে ৪৪৪ কোটি ৮৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে মোটরযান ক্রয় খাতে ৩২৮ কোটি ৩৩ লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। অধিদপ্তরের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাপ্ত বাজেটের মধ্যে আন্তঃখাত সমন্বয় করে গাড়ি কেনার লক্ষ্যে আরও ২০ কোটি টাকার সংস্থান করা সম্ভব হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত গাড়ি কেনা বাবদ মোটরযান ক্রয় খাতে ৯৬ কোটি ৫১ লাখ ৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রয়োজন হবে।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত ৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত ‘শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা ৩০টি গাড়ি নিলামে প্রত্যাশিত দর না পাওয়ায় বিকল্প উপায়ে নিষ্পত্তি এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রী ও সমপদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের ব্যবহারের লক্ষ্যে গাড়ি ক্রয় সংক্রান্ত’ আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এসব গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই সভায় সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর থেকে আপাতত উপযোজনের মাধ্যমে অর্থের সংস্থান করে গাড়ি কেনার ব্যবস্থা করা এবং একান্ত প্রয়োজনে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের জন্য অর্থ বিভাগে প্রস্তাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

গাড়ি কিনতে শর্ত

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ বিভাগ কয়েকটি শর্তে ২৮০টি কেনার জন্য মোট ৪৪৪ কোটি ৮৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা ব্যয়ের সম্মতি দিয়েছে। এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে-

>> নতুন কেনা জিপ গাড়িগুলো টিওঅ্যান্ডইতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং প্রতিস্থাপক হিসেবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কার্যালয়ের জন্য কেনা জিপ গাড়ি ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের জন্য প্রতিস্থাপক হিসেবে কেনা মাইক্রোবাসগুলো অকেজো ঘোষণা সংক্রান্ত বিআরটিএর পরিদর্শক দলের অনুমোদন গ্রহণ করে তার অনুলিপি অর্থ বিভাগে পাঠাতে হবে।

>> গাড়ি কনডেমনেশন সংক্রান্ত কমিটির মিটিং করে তার অনুলিপি অর্থ বিভাগে পাঠাতে হবে।

>>গাড়িগুলো অকেজো ঘোষণার পর সেগুলো বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ অর্থ চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে, তার অনুলিপি অর্থ বিভাগে পাঠাতে হবে।

>>গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন-২০০৬ ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮ নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।

>> প্রতিস্থাপন করা জিপ গাড়ি, মাইক্রোবাসগুলো কেনার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাজেট থেকে সংকুলান করতে হবে (প্রয়োজনে উপযোজন করে)।

>>এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব বিধি-বিধান, আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হবে।

এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘এমন সময় এসব গাড়ি কেনার সম্মতি দেওয়া হয়েছে, যে সময় অর্থ উপদেষ্টা দেশের বাইরে রয়েছেন। আবার সরকার ব্যয় সংকোচন নীতি অনুসরণ করছে। এ মুহূর্তে ২৫৫টি দামি গাড়ি কেনা নিয়ে বিভিন্ন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। আবার মন্ত্রীদের জন্য যে গাড়ি কেনা হবে, সেই একই গাড়ি কেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্য কেনা হবে তাও বোধগম্য নয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা এত দামি গাড়ি কী কাজে ব্যবহার করবেন।’

যোগাযোগ করা হলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগামী সরকারের মন্ত্রীর জন্য গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত এত তাড়াতাড়ি নেওয়া হচ্ছে কেন, তা আমার বোধগম্য নয়। তাছাড়া এগুলো তো দামি গাড়ি। আগের যে গাড়িগুলো আছে, সেগুলো একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে বা অকেজো তা তো নয়। তাহলে এই মুহূর্তে এতগুলো দামি গাড়ি কেন কেনা হবে। অর্থনীতির অবস্থাও তো খুব ভালো অবস্থানে নয়, রেভিনিউ আয়ও খুব ভালো হয়েছে তেমটিও না। সুতরাং, এই মুহূর্তে এতগুলো দামি গাড়ি কেনার যৌতিকতা আমি দেখি না।

মন্ত্রীদের জন্য যে গাড়ি কেনা হবে, একই মানের গাড়ি কেনা হবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্য। এটা কতটুকু যুক্তসংগত? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা তো প্রত্যন্ত অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করেন। তারা যেসব রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করেন, অনেক সময় দেখা যায় সেই রাস্তা ভাঙা, কাদা থাকতে পারে। সুতরাং, তাদের জন্য এমন রাস্তায় চলাচলের উপযুক্ত গাড়ি কেনা যেত। কেন তাদের জন্য এত দামি গাড়ি কেনা হবে, কোন যুক্তিতে এটা করা হচ্ছে, তার উত্তর আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না।’