Image description

‘আমার ছেলে বাঁচি থাকি কিছু করি মনে হয় না খাইতে পারবে, তারপরও বাঁচি থাকুক। আমার জন্য সে বাঁচি থাকুক। সবাই বলতেছে যে বাঁচি থাকি মনে হয় না ছেলে কিছু করি খাইতে পারবে।’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় সন্ত্রাসীদের রামদার কোপে গুরুতর আহত শিক্ষার্থী নাইমুল ইসলাম রাফির প্রসঙ্গে কান্নাভেজা কণ্ঠে এসব কথা বলছিলেন তার মা রেহানা আক্তার।

রাফি চবির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার ইছাপুর ইউনিয়নের মফিজুল ইসলাম ও রেহানা আক্তার দম্পতির সন্তান। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে রাফি দ্বিতীয়। বাবা মফিজুল ইসলাম কাতারপ্রবাসী। আর মা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পের শিক্ষক।

গত শনিবার রাতে বাসার দারোয়ান কর্তৃক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী হেনস্তাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া সংঘর্ষের দ্বিতীয় দিন রবিবার বেলা দুইটা-আড়াইটার দিকে গুরুতর আহন হন রাফি। সংঘর্ষের সময় তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে রামদার কোপ দেয় সন্ত্রাসীরা। ডান হাতের কনুই প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কেটে যায় হাত-পায়ের কয়েকটি রগ। সোমবার ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে প্রাথমিকভাবে তার রক্তনালীর অস্ত্রোপচার করা হয়। তিনি বর্তমানে আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে এক মাস পর তার বাকি রগের অস্ত্রোপচার করতে হবে। রাফি বর্তমানে হাসপাতালটির কার্ডিওভাসকুলার আইসিইউতে চিকিৎসকদের নিবিড় পরিচর্যায় রয়েছেন।

আইসিইউর বাইরে ছেলের শরীরে আঘাতের বিবরণ দিতে গিয়ে অশ্রু গড়িয়ে আসে রেহানা আক্তারের দু’চোখে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, রবিবার সকালে ও (রাফি) ঘুমিয়েছিল। ঘুম থেকে উঠে হয়তো খাওয়ার জন্য বের হয়েছে। এ সময় দুজন ছাত্রের উপর হামলার খবর পেলে ও তাদের সাথে যোগ দেয়।

তিনি বলেন, কেউ বলে মাথায় ছয়টা কোপ আছে। রাফির কাছে সামান্য কথা শুনেছি, মাথায় নাকি দুইটা বারি দেয়া হয়েছে। এর বেশি বলতে পারেনি। ডান হাত আগেও একবার ভেঙেছিল। এখন আবার ওই হাতটায় বাজেভাবে ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া বাম হাতে, দুই পায়ে, আমার ছেলের পুরা শরীরে কোপ আছে। পিঠে সব ক্ষত-বিক্ষত অবস্থা। জায়গায় জায়গায় কালো কালো হয়ে গেছে।

সফল অস্ত্রোপচারের পর রাফি আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে কর্মক্ষম থাকতে পারবে কিনা—তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। মা রেহানা আক্তার বলেন, ডাক্তাররা বলে ছেলে ভালো হবে, তবে দীর্ঘ সময় লাগবে। আর ডান হাতে কোনো কাজ করা যাবে না। তাকে দিয়ে ডান হাতের ব্যবহার হয় এমন চাকরিও করতে পারবে না।

লক্ষ্মীপুরের আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে বাঁচি থাকি কিছু করি মনে হয় না খাইতে পারবে, তারপরও বাঁচি থাকুক। আমার জন্য সে বাঁচি থাকুক। সবাই বলতেছে যে বাঁচি থাকি মনে হয় না ছেলে কিছু করি খাইতে পারবে।’

rafi

চবি মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়ার পর রাফি

‘আমার সোনার পুতুল ছেলে’
২০২২ সালে রাজধানীর কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে আলিম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন রাফি। পঞ্চম শ্রেণিতেও জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন তিনি। ছোট বেলা থেকেই শান্ত-শিষ্ট রাফি মায়ের কাছে তাই ‘সোনার পুতুল’।

রেহানা আক্তার বলেন, আমার অবাধ্য, বাপের অবাধ্য কখনো হয় নাই। টাকা-পয়সা দিলে আমার ছেলে এত সেভ করে চলত যে (চিন্তা করত) বাবার কষ্ট আছে। আমার ছেলে ওইখানে (ক্যাম্পাস) কষ্ট করে চলে, বাড়ি গেলে দোকানে দশটা মিনিট বসে না। যদি কোনো কিছু খাইতে মনে চাইত, বাসায় নিয়ে এসে বোনেদের নিয়ে খেত এক সাথে। কোনো জায়গায় কোনো আড্ডা নাই আমার ছেলের। চাচাতো ভাই-জ্যাঠাতো ভাইদের সাথে দেখা হলে সালাম দিবে, হাসিমুখে কথা বলবে—এই। আশেপাশের মানুষ আমার ছেলের জন্য কান্দে। এই সোনার পুতুলটা আমার...।

শত কষ্টেও ছেলে কোনো দিন মুখ ফুটে টাকা চায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ফোন করলে জিগাইতাম, বলত এত আছে, এত আছে। আর লাগবে? এটা বললে চুপ করে থাকত। পরে আমি যেমনে পারতাম, ম্যানেজ করে দিতাম। দিতাম ঠিক আছে, কিন্তু আমার ছেলে যদি এখান থেকে কিছু বাঁচাতে পারত, তাইলে বাড়িতে গিয়ে বাজার করত। বাজার করে ঘরের সবাইরে নিয়ে খাইত।

‘হাজারের মধ্যে বেছে আমার একটা ছেলে, একটা ছেলের মতনই হইছে’—যোগ করেন তিনি। বলেন, আমার ছেলে নামাজ পড়ে। রমজান মাসে তাহাজ্জুদ পড়ে, ভোররাতে ফজর পড়ে তারপরে ঘুমাত। চাকরি নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিল না। কখনও এরকম কিছু প্রকাশ করেনি। তবে বলত, ঘুষ দিয়ে চাকরি করবে না। এমনিতে চিন্তা ছিল ব্যবসা করার।

রেহানা আক্তার বলেন, একবার আমি ওর বাবাকে বলেছিলাম, ছেলের আর পড়ানোর দরকার নাই, কাজে-কর্মে লাগিয়ে দাও। ওর বাবা বলছে, আমার একটা মাত্র ছেলে, আরও যদি দুই-তিনটা ছেলে থাকত, তাদের পিছে খরচ করা লাগতো না। যদি আমি মারাও যায়, আমার একটা মাত্র ছেলে বলবে যে আমার পড়ালেখার আশা ছিল, আমার মা-বাবা আমাকে পড়ালো না। এ ছাড়া ছেলের আগ্রহ আর রেজাল্টের কারণে পড়াইতে উৎসাহ দিয়েছি। সব বাবা-মা চায় ছেলে তাদের স্বপ্ন পূরণ করুক। আমরাও চেয়েছিলাম, ছেলেকে অনেক শিক্ষিত বানাব, মানুষ করব।

‘রিং হয় কিন্তু কেউ রিসিভ করে না, আমার ভিতরে কেমন জানি মোড়া দিছে’
রবিবার দুপুরে সংঘর্ষের খবর পেয়ে এক আত্মীয় রেহানা আক্তারকে কল দিয়ে নাইমুল ইসলাম রাফির খোঁজ নিতে বলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাফিকে কল দেন। কিন্তু সাড়াশব্দ পাননি। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, রিং হয়, কিন্তু কেউ রিসিভ করে না। আমার ভিতরে কেমন জানি মোড়া দিছে। দুপুরে আমি ভাত খাইতে বসেছি, দুই-তিন লোকমা ভাত খেয়ে আর খাইতে পারি নাই। হাত ধুয়ে উঠে গেছি। পরে ফোন দিছি তার আব্বুর কাছে, রাফি আমার ফোন তো ধরে না। আপনি একটু দেখেন। তার ফোনও ধরে না। পরে ভাসুরের ছেলে আর মেয়ে জামাইয়ের মাধ্যমে খোঁজ নিয়েও কিছু জানতে পারি না। আমি নিরাশ হয়ে গেছি। আল্লাহর কাছে বলা ছাড়া কিছু নাই। পরে রাত নয়টা-সাড়ে নয়টার দিকে ভার্সিটির মানুষজন গার্ডিয়ান খোঁজে।

তিনি বলেন, ওই দিন সারাদিন কেউ আমাকে মোবাইল দেয়নি। রাতে তিনটার দিকে আমি ফেসবুকে ঢুকে আমার ছেলের আহত অবস্থার ভিডিওগুলো দেখতে পাই। তার বাবা তো ওখানে (প্রবাস) অস্থির। চোখে-মুখের অবস্থা পুরা খারাপ। সারা দিন-রাত কাঁদে। আবার আসতেও পারে না, টাকা-পয়সার পরিস্থিতি তেমন ভালো নাই। পায়েরও অসুখ। হাটতে পারে না। এদিকে ছয়-সাত বছর ধরে আমারও ডায়াবেটিস। একমাত্র আশা-ভরসা ছিল এই ছেলে।

‘বিচার কী? আমি কারো জন্য মামলা করব না’
একমাত্র ছেলেকে গুরুতর আহত করা ব্যক্তিদের ইহকালীন শাস্তি চান না রেহানা আক্তার। তাঁর ভাষায়—‘আমি কারো জন্য মামলা করব না। আমি কাউকে কিছু বলব না। আমি যেন আমার ছেলের বিনিময়টা আখিরাতে পাই। আখিরাতের আদালতে ডায়েরি করব ওই দিন, আমার ছেলের অপরাধটা কী ছিল? সেদিন আখিরাতের আদালতে আল্লাহর কাছে বিচার দিব।’

‘নাইমুলের শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল’
রবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী জোবরা গ্রামের ইমাম বুখারি মডেল মাদ্রাসার আশপাশের এলাকায় আহত হন রাফি। ওইদিন সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিলে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তিনি। এলোপাতাড়ি কোপাতে দেখে একদল শিক্ষার্থী এগিয়ে এসে তাকে উদ্ধার করে। উদ্ধার করা শিক্ষার্থীদের একজন শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছাত্র আহমেদ জুনাইদ। ওইদিনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে জুনাইদ লিখেছেন, নাইমুলকে আমি যখন প্রথম ধরি, পুরো শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। মাথায়, পায়ে, হাত, উরুতে কয়েক জায়গায় কোপানো হয়েছে।

জানতে চাইলে আহমেদ জুনাইদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার এক পর্যায়ে ওকে কোপ দেয়া হয়। ও পড়ে যাচ্ছিল, আমরা দৌঁড়ে ওকে রক্ষা করি। তখন ও শুধু হাসফাঁস করছিল। উদ্ধার করে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেলে নিই। সেখানে ওর রক্তপাত বন্ধ করা হয়। প্রচুর রক্তপাত হচ্ছিল। আমার পুরো শরীর রক্তে ভিজে গিয়েছিল। ঘটনাস্থল থেকে মেডিকেল পর্যন্ত প্রচুর রক্ত গিয়েছে। মেডিকেলে ব্যান্ডেজ করে রক্তপাত বন্ধের চেষ্টা করা হয়। এরপর তাকে চমেকে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

চিকিৎসা ব্যয় বহন করবে বিশ্ববিদ্যালয়
নাইমুল ইসলাম রাফিসহ দুদিনের সংঘর্ষে আহত ৫ শতাধিক শিক্ষার্থীর চিকিৎসা ব্যয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বহন করবে বলে জানিয়েছেন প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন। বৃহস্পতিবার তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় আহতদের চিকিৎসার পুরো খরচ বহন করছে। আহত শিক্ষার্থীকে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছি আমরা। আর আমাদের বাইরে আহতদের জন্য কেউ খরচ করলে সেটা আমাদের জানানো হলে ব্যয় বহন করব। এটি আমাদের সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত।

এ ছাড়া আহত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে ভিসি, প্রো-ভিসি ও ছাত্র উপদেষ্টাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।