Image description

কোরআনের তাফসির বা মাহফিল উপমহাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও মুসলিম সামাজিক ঐতিহ্য। কোরআনের তাফসিরের মাধ্যমে মানুষকে শুধু নৈতিক শিক্ষাই দেওয়া হয় না বরং মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, পারস্পরিক সহযোগিতা বোধ জাগিয়ে তোলা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করা হয়। ব্রিটিশ শাসনের সময় উপমহাদেশে ইসলামী মূল্যবোধ ও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার জন্য তাফসির মাহফিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেসময় উর্দু, বাংলা ও স্থানীয় ভাষায় মাহফিলগুলো ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে মুসলিম সামাজিক এ ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। যারা মানুষকে কোরআনের কথা শুনিয়েছেন তাদেরকে বিনা অভিযোগে ধরে নেওয়া হয়েছে। গুম করার চেষ্টা করা হয়েছে। দিনের পর দিন রিমান্ডের নামে চালানো হয়েছে অকথ্য নির্যাতন। শুধু কোরআনের কথা বলার জন্য রিমান্ডে নিয়ে বিবস্ত্র করে গোপনাঙ্গে কারেন্টের শক দেওয়া হয়েছে।

তাফসির মাহফিলে কোরআনের সুরার শাব্দিক অর্থ, নাজিল হওয়ার কারণ ও ব্যাখ্যার পাশাপাশি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরোধিতাকারী ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন আলেম সমাজ। কোরআরানের আলোকে কথা বলা ও ফ্যাসিস্টদের সমালোচনা করার জন্য মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগে আলেমদের রিমান্ডের নামে নির্যাতন চালানো হতো।

২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদির বাংলাদেশে আসার বিরোধিতা করে বিভিন্ন মাহফিলে কথা বলেন শায়খুল হাদিস মাওলানা মামুনুল হক। সে সময় ভারতের গুজরাটে মুসলিম নিধনের হোতা হিসেবে খ্যাত নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আসার বিরোধীতা করে আন্দোলনে মাঠে নামেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। দিনে-দুপুরে একে একে ১৮ জনকে শহীদ করে আওয়ামী ফ্যাসিস্টের দোসর সেই সময়ের পুলিশ প্রশাসন।

আলেমগণ নবীদের ওয়ারিশ। তারা মানুষকে ধর্মীয় বিষয় বোঝাবেন, দেশবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করবেন সেটাই তাদের দায়িত্ব। এ বিষয়ে কথা বলেন ইসলামী দাওয়াহ সেন্টার ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও ধানমন্ডি সাইন্সল্যাবরেটরী কেন্দ্রীয় জামে মাসজিদের খতিব মুফতী মুহাম্মাদ শামছুদ্দোহা আশরাফী। তিনি বলেন, ওয়াজ ও দোয়া মাহফিল মুসলিম সভ্যতার অংশ। উপমহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ওয়াজ মাহফিলের প্রচলন আছে। এই ওয়াজ মাহফিল কোরআন হাদিস দ্বারাও প্রমাণিত। আল্লাহপাক কোরআনে বলেছেন, তোমরা মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করো। আর রবের দিকে আহ্বান করার কাজটি ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। এই ওয়াজ মাহফিল থেকে মানুষ প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাও পেয়ে থাকেন। দেশের বিভিন্ন সঙ্কটে ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে বড় ভূমিকা রাখা সম্ভব।

ধর্মীয় ও মুসলিম সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ এই ঐতিহ্যকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করে হেয়ভাবে উপস্থান করা হতো। ওয়াজের সময় কোন আলেম কিভাবে অঙ্গভঙ্গি করেন। সেই বিষয়গুলো তুলে ধরে ঢালাও ভাবে প্রচার করা হতো দেশের বিভিন্ন মিডিয়াতে। পুরো দেশের আলম সমাজকে হেয় করা হতো। এভাবে হেয় প্রতিপন্ন করেও যখন আলেমদের কথা বলা থেকে বিরত রাখা যাচ্ছিল না। তখন তাদের উপর প্রশাসনিকভাবে দমনের চেষ্টা করা হয়। তাদের নামে দেওয়া হয় হাজারো মিথ্যা মামলা। আবার অনেককে তো মামলা ছাড়াই আটক করা হয়। গুম করার চেষ্টা করা হয়। এ বিষয়ে কথা বলেন, ইসলামি আলোচক শায়খ মুফতি আলী হাসান উসামা। তিনি বলেন, আওয়ামী দুঃশ্বাসনের সময় সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যারা ওয়াজ মাহফিলের বক্তারা। যারা মানুষকে সচেতন করতে পারেন তাদের একটি তালিকা করে হাসিনা সরকার স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দিয়ে রেখে ছিল। তারা আলোচনা করতে গেলে বাধা দেওয়া হত। যারা সরকারের দালালি ও চামচামি করতো না তাদের আলোচনা করতে দেওয়া হতো না। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হওয়ায় বর্তমানে মাহফিলগুলো প্রাণ ফিরে পেয়েছে। যদি এভাবে চলতে পারে তাহলে বাংলাদেশে ধর্ম প্রচারের জায়গাটা স্বাধীন থাকবে। আমরা আশা করবো এ দেশে আর কোনো ফ্যাসিবাদ জন্ম নেবে না।

হাসিনা সরকার জনপ্রিয় ইসলামি আলোচক ড. মিজানুর রহমান আজহারীকে দেশ ছাড়া করেছিল। ওয়াজ মাহফিলে কথা বলাই ছিল তার একমাত্র অপরাধ। তার আলোচনা শুনতে মানুষের ঢল বয়ে যেত। এটাই সহ্য করতে পারেনি আওয়ামী সরকার। তাকে দীর্ঘদিন জন্মভূমি বাংলাদেশে আসতে দেওয়া হয়নি। হাসিনার পতনে তিনিও দেশে ফিরেছেন। নতুন বছরের শুরুর দিন যশোরে তিনদিনব্যাপী তাফসিরুল কোরআন মাহফিলের আয়োজন করে আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশন। এতে মিজানুর রহমানের আলোচনা শুনতে লাখ লাখ মানুষ আসেন সেই তাফসির মাহফিলে। দীর্ঘদিন পর দেশের মানুষ এতো সুন্দর ও বড় একটা তাফসির মাহফিল দেখেছে। শ্রোতারা আজহারীর তাফসির শুনে মুগ্ধ হয়েছেন। তিনদিনব্যাপী এ আলোচনার প্রথম দিন বুধবার (১ জানুয়ারি) আলোচনা করেন আল্লামা মামুনুল হক ও আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ। বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিন আলোচনা করেন মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী ও মুফতি আমির হামজা। শেষ দিন শুক্রবার আলোচনা করেন শায়খ আহমাদুল্লাহ ও ড. মিজানুর রহমান আজহারী।

হাসিনা সরকার তাফসিরুল কোরআন মাহফিলে তো বাধা দিতোই। এমনকি মসজিদের ইমামদেরও স্বাধীনভাবে কথা বলতে বাধা দিত। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সহসভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব বলেন, আওয়ামী লীগ যেটা করেছে সেটা ছিল নির্লজ্জ। তাদের শাসনামলে জুমার খতিবের মিম্বারও নিরাপদ ছিল না। এমনকি ঘরোয়া কোনো ধর্মীয় তালিমও নিরাপদ ছিল না। শুধু মাহফিলই নয় সব মাদরাসা-মসজিদেই নিজেদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সারা দেশেই তারা একটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। কেউ-ই কোনো কথা বলতে পারেননি। আমরা যারা কিছু কথা বলেছি, তাদেরকে করা হয়েছে নির্যাতন। এখন আলহামদুলিল্লাহ পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে।