মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রবাসী নাগরিকদের তথ্যভান্ডার পাচারের অভিযোগ উঠেছে। প্রায় ১৫ লাখ প্রবাসীর সংবেদনশীল তথ্য বেসরকারি আউটসোর্সিং কোম্পানি এক্সপার্ট সার্ভিস (ইএসকেএল)-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রবাসীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। কালবেলার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য।
২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিল দূতাবাস থেকে ই-পাসপোর্ট সংক্রান্ত সার্ভারসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বেআইনিভাবে ইএসকেএলের নিজস্ব অফিসে সরিয়ে নেওয়া হয়। দূতাবাসের ছুটির দিনে তার কেটে, সার্ভারের যন্ত্রপাতি খুলে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও ফুটেজও কালবেলার হাতে এসেছে। তথ্য স্থানান্তরের এই ঘটনায় রাষ্ট্রীয় বিপুল পরিমাণ অর্থের ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত বছরের ১৮ এপ্রিল কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের তৎকালীন সচিব মো. আব্দুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী এবং হাইকমিশনার মো. শামিম আহসানের উপস্থিতে ই-পাসপোর্ট সেবা শুরু উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের ঠিক দুদিন পরই ২০ ও ২১ এপ্রিল বন্ধের দিনে দূতাবাসের কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই বাংলাদেশ মিশনের পাসপোর্ট সেন্টার থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, ভিসা ও পাসপোর্ট সংক্রান্ত প্রবাসীদের ‘ডাটা সার্ভার’ এক প্রকার সন্ত্রাসী কায়দায় খুলে নিয়ে যায় ইএসকেএল। পরে পাসপোর্টের এসব যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয় সাউথ গেট কমার্শিয়াল সেন্টারে অবস্থিত ইএসকেলের নিজস্ব অফিসে।
কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ মিশনের পাসপোর্ট সার্ভিস সেন্টারের সার্ভার কক্ষের কিছু গোপন ভিডিও এসেছে কালবেলার হাতে। এসব ভিডিওতে দূতাবাসের ওয়্যারিংয়ের তার কেটে পাসপোর্টের ডাটা সার্ভার তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রমাণ মিলেছে। সার্ভার কক্ষের জন্য ফ্লোর দিয়ে টেনে আনা ওয়্যারিং ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কানেকশনেরও সবকটি তার এমনভাবে কাটা হয়েছে যে তা ফের চাইলেও যুক্ত করা সম্ভব নয়। তাড়াহুড়া করে এসব তার কেটে যন্ত্রপাতি সরাতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় বিপুল পরিমাণ অর্থের ক্ষতি হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সার্ভারসহ ই-পাসপোর্ট সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম লোপাটে দূতাবাসের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা: আইটি বিশেষজ্ঞ শামীম সরকার কালবেলাকে বলেন, ‘যে কোনো ফিজিক্যাল সার্ভার স্থানান্তর হলে তথ্য নিরাপত্তার মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়। ডাটা এনক্রিপ্ট থাকলেও সার্ভারের হার্ডওয়্যারের হার্ডড্রাইভ ফিজিক্যাল অ্যাক্সেসের মাধ্যমে ডাটা ক্লোন করা সম্ভব। ডিআইপি একটি ওরাকল সিকিউরিটি। এর সঙ্গে ফিজিক্যাল হার্ডড্রাইভ অ্যাক্সেসের সম্পৃক্ততা নাই। এ পরিস্থিতিতে ডার্কনেটে ডাটা বিক্রির আশঙ্কা থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত সার্ভার বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে, ততক্ষণ তথ্য নিরাপদ। দূতাবাস থেকে সরিয়ে ফেলা হলে এটি গুরুতর নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ।’
দূতাবাসের ব্যাখ্যা ও বিতর্ক: দূতাবাসের ডেপুটি হাইকমিশনার খোরশেদ খাস্তগীর তথ্যভান্ডার স্থানান্তরের বিষয়টি স্বীকার করলেও দাবি করেন, ‘এটি ই-পাসপোর্ট সেবার এক ছাদের নিচে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য করা হয়েছে। ডাটা সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের ডিআইপি সার্ভারে সংরক্ষিত থাকে, তাই নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের প্রয়োজন নেই।’ তবে এ বক্তব্যকে অসত্য আখ্যা দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডাটা সরানোর প্রক্রিয়া নিজেই তথ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন: চুক্তি অনুযায়ী ইএসকেএলকে মালয়েশিয়ার তিনটি শহরে (কুয়ালালামপুর, জোহর বাহরু, পেনাং) ই-পাসপোর্ট সেবা কেন্দ্র নির্মাণ করতে বলা হয়েছিল; কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পার হলেও শুধু কুয়ালালামপুরে একটি অফিস স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে মালয়েশিয়ার ১৩টি প্রদেশ থেকে প্রবাসীদের কুয়ালালামপুরেই সেবা নিতে বাধ্য করা হচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ উপেক্ষা: প্রবাসী সেবার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে ইএসকেএলের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু দূতাবাস এই নির্দেশ অমান্য করে কোম্পানিটিকে আরও তিন মাস সময় দেয়। মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনু বিভাগের মহাপরিচালক নাঈম উদ্দিন জানান, ‘চুক্তি বাতিল করা হয়েছে বলেই আমাদের জানানো হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে তারা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তা দেখা দরকার।’
তথ্য পাচারের আশঙ্কা: ডাটা নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সার্ভারের তথ্য সরানোর ফলে প্রবাসী নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও বায়োমেট্রিক তথ্য ডার্কনেটে বিক্রির ঝুঁকি রয়েছে। প্রকৌশলী শামীম সরকার বলেন, ‘বায়োমেট্রিক তথ্য এনক্রিপ্ট থাকলেও ফিজিক্যাল অ্যাক্সেসের মাধ্যমে তা ডিক্রিপ্ট করা সম্ভব। এ ধরনের সংবেদনশীল তথ্য হাতছাড়া হলে জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।’
কাজের পেছনে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যোগসাজশ: অনুসন্ধানে জানা যায়, ইএসকেএলের মালিক গিয়াসউদ্দিন এক সময় বাংলাদেশে গরুর খামার চালাতেন। তিনি এক সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রীর পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার মাধ্যমেই এই কোম্পানি মালয়েশিয়ায় অনুমোদন পায় এবং দরপত্র ছাড়াই গুরুত্বপূর্ণ ডেটা সার্ভারের কাজ পায়। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দূতাবাস কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই এ চুক্তি হয়েছে।
প্রবাসীদের শঙ্কা: মালয়েশিয়ায় কর্মরত প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি এখন তাদের তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। প্রবাসী সেবা কার্যক্রমের আড়ালে দূতাবাসের এমন অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করতে উচ্চপর্যায়ের তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তারা।
দূতাবাসের কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার এ ঘটনা প্রবাসীদের জন্য বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তথ্য পাচার ও চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি উঠেছে। একই সঙ্গে প্রবাসী সেবার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।