
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পদোন্নতি নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা ছিল। বেশিরভাগ মহাব্যবস্থাপক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে আওয়ামী মতাদর্শের লোকদের পদোন্নতি দেওয়া হতো। এতে অনেক কর্মকর্তা ওই আমলে যথাসময়ে পদোন্নতি না পেয়ে বঞ্চিত হন।
তবে সরকার পতনের পর অনেক বঞ্চিত কর্মকর্তা পদোন্নতি পেলেও তাদের এমডি হওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমডি নিয়োগে প্রস্তাবিত নীতিমালায় বলা হয়েছেÑএমডি হতে হলে দুবছর ডিএমডি পদে থাকতে হবে। আগে যদিও এমন কোনো নিয়ম ছিল না। এখন যদি এই প্রস্তাবিত নীতিমালা পাস হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ আমলে যারা দলীয় আনুকূল্য পেয়ে ডিএমডি হয়েছেন, তারাই এখন এমডি হিসেবে পদোন্নতি পাবেন! ফলে সম্প্রতি যেসব কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন, তাদের এমডি হওয়ার সুযোগ থাকছে না। কারণ, পদোন্নতি পাওয়ার পর তাদের ডিএমডি পদে দুবছর পূর্ণ হয়নি। এ নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) এবং মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন নীতিমালা ২০২৫-এর একটি খসড়া তৈরি করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের এমডি হতে হলে ন্যূনতম স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকতে হবে এবং শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়ে তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি থাকতে পারবে নাÑএমন ধারা যুক্ত হচ্ছে নীতিমালায়। গ্রেডিং পদ্ধতিতে প্রকাশিত ফলাফলের ক্ষেত্রে এসএসসি বা সমমান ও এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষায় জিপিএ ৩-এর কম হতে পারবে না। অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয় যে সিজিপিএ দেয়, তা ৪ পয়েন্ট মাত্রার ক্ষেত্রে ২ দশমিক ৫ এবং ৫ পয়েন্ট মাত্রার ক্ষেত্রে ৩-এর কম হলে গ্রহণযোগ্য হবে না। এ ছাড়া যারা এমডি হতে চান, তারা যদি অর্থনীতি, হিসাববিজ্ঞান, ফিন্যান্স, ব্যাংকিং, ব্যবস্থাপনা বা ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে উচ্চতর প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাগত শিক্ষা নিয়ে থাকেন, তাহলে তা অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। বিদ্যমান নীতিমালায় এসব বিষয়ে কিছু বলা নেই।
খসড়া নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, এমডি হতে গেলে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পাশাপাশি ডিএমডি হিসেবে দুবছরের কর্ম-অভিজ্ঞতা লাগবে। আগে নিয়মিতভাবে পদোন্নতি পাওয়া উপব্যবস্থাপনা পরিচালকরা এমডি হিসেবে নিয়োগ পেতেন।
খসড়া নীতিমালা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সম্প্রতি পদোন্নতি পাওয়া কয়েকজন ডিএমডি আমার দেশকে জানান, এমডি পদোন্নতি নীতিমালায় ডিএমডি হিসেবে দুবছরের কর্মকালের উল্লেখ রয়েছে, যা নতুন করে বৈষম্যের সৃষ্টি করবে। কারণ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় বিভিন্ন সময়ে পদোন্নতি দেওয়া হতো তাদের নিজস্ব নীতিমালায়। এর ফলে কোনো ব্যাংকের কর্মকর্তা যথাসময়ে পদোন্নতি পেলেও অন্য ব্যাংকের কর্মকর্তারা পদোন্নতিতে অনেক পিছিয়ে ছিলেন। দেখা যেত একটি ব্যাংকের কর্মকর্তারাই এমডি হচ্ছেন। তারাই বাকি ব্যাংকগুলোতে নেতৃত্ব দিতেন। এতে জুনিয়র ও সিনিয়রের ভারসাম্য অনেকাংশে বিনষ্ট হয়ে যথার্থ কর্মপরিবেশ বজায় থাকছে না।
তারা আরো জানান, দুবছরের ডিএমডি থাকা বিবেচনায় না নিয়ে মোট কর্মকাল গণনা করলে দীর্ঘদিনের এই বৈষম্য দূর হবে এবং যোগ্য ব্যাংকিং নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। এছাড়া প্রস্তাবিত নীতিমালায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে এমডি পদোন্নতিতে ২০ বছরের কর্ম-অভিজ্ঞতার উল্লেখ রয়েছে। এই কর্ম-অভিজ্ঞতার সুনির্দিষ্ট কোনো বিবরণ নেই, যেটি দক্ষ এমডি নিয়োগের যথার্থতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
তারা মনে করেন, এমডি নিয়োগে ব্যাংকিং বিষয়ে পেশাগত জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি ২৫ বছরের কর্ম-অভিজ্ঞতা থাকা উচিত। এ কর্মকালে মাঠ পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা তথা শাখা, করপোরেট শাখা, জেলা ও বিভাগীয় কার্যালয় এবং স্থানীয় কার্যালয়ের মতো করপোরেট এস্টাবলিশমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফাইন্যান্স, জেনারেল অ্যাডভান্স, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট, ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ডিভিশনে কাজের অভিজ্ঞতা ও ব্যাংকের পক্ষে উল্লেখযোগ্য অর্জনকে বিবেচনায় নিয়ে নীতিমালা করা আবশ্যক।
এ বিষয়ে জানতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেককে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠালে তিনি কোনো উত্তর দেননি।
ডিএমডি ও জিএম নিয়োগে নিয়ম বদল
রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিএমডি এবং জিএম পদে পদোন্নতি অথবা আন্তঃব্যাংক বদলির মাধ্যমে নিয়োগ ও পদায়ন হবে। ডিএমডি হতে গেলে ২০ বছরের কর্ম-অভিজ্ঞতা লাগবে। এর মধ্যে জিএম হিসেবে দুবছর কাজ করা বাধ্যতামূলক, যা আগেও একই ছিল। আর জিএম হতে গেলে মোট ১৮ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এর মধ্যে উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) পদে তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকা বাধ্যতামূলক।
অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের উচ্চতর পদে সরাসরি নিয়োগ করার বিধান আগেও ছিল, নতুন নীতিমালায়ও থাকছে। সে ক্ষেত্রে ডিএমডি পদের জন্য প্রিন্সিপাল অফিসার (পিও) পদে ১৭ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, যা বর্তমানে ১৪ বছর। সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার (এসপিও) পদের জন্য ১৪ বছর, সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) পদের জন্য ১১ বছর এবং ডিজিএম পদে সরাসরি নিয়োগের জন্য আট বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
জিএম পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রেও পিও হিসেবে ১৫ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, যা বর্তমানে ১২ বছর। এছাড়া এসপিও পদে ৯ বছরের বদলে ১২ বছর এবং এজিএম পদে ছয় বছরের বদলে ৯ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্তদের ডিজিএম পদে ছয় বছরের অভিজ্ঞতা থাকার কথা বলা হয়েছে, যে সুযোগ এতদিন ছিল না।