Image description

আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মাঠ প্রশাসনকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণের নির্দেশনা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া জননিরাপত্তা নিশ্চিতে সব ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতেও বলা হয়েছে। সর্বোপরি, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে এখন থেকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে, সেটিও দূর করতে হবে।

পাশাপাশি, আসন্ন দুর্গাপূজায় যে কোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে প্রতিটি পূজাম-প ঘিরে সর্বোচ্চ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যেন কোনো ধরনের অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে, এ জন্য আরও সজাগ থাকতে বলা হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে কেউ যেন অপতথ্য ছড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে, সেই লক্ষ্যে নজরদারি কার্যক্রম আরও বৃদ্ধির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে- যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতা মোকাবিলায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে মাঠ প্রশাসনের যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে। চাঁদাবাজি রোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের উপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বৈঠক-সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ডাকসুসহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সূত্র মতে, এসব নির্বাচন ঘিরে যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সেদিকেও মাঠ প্রশাসনকে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে।

দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে গতকাল বুধবার দুপুরে এই ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি। বৈঠকে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে দেশের সর্বশেষ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে তারা কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, সে সম্পর্কে অবহিত হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর পরই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, দুর্গাপূজায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে একগুচ্ছ নির্দেশনা প্রদান করেন সচিব নাসিমুল গনি।

সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়- আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সে অনুযায়ী মাঠ প্রশাসনকে এখন থেকে ভোটের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে এক ধরনের উদ্বেগ ও শঙ্কা কাজ করছে। মানুষের সেই শঙ্কা দূর করতে হবে। এ ছাড়া অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণে এখন থেকেই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে জোরালোভাবে কাজ শুরু করতে হবে।

বৈঠকে সব বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশের সব রেঞ্জ ডিআইজি, জেলা প্রশাসক (ডিসি), সব মহানগর পুলিশ কমিশনার এবং জেলা পুলিশ সুপাররা অংশগ্রহণ করেন।

গত কয়েক দিনে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ-সংঘাত-উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষসহ কয়েকটি পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া নুরুল হক নূরের ওপর হামলাসহ বেশকিছু ঘটনা উত্তাপ ছড়িয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এমন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটেই গতকাল মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে এই বিশেষ ভার্চুয়াল বৈঠকের আয়োজন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন রেঞ্জ ডিআইজি আমাদের সময়কে বলেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচন উপযোগী করে তোলার বিষয়ে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে মব সন্ত্রাস দমনে আইনের মধ্যে থেকে পুলিশকে কঠোর হতে বলা হয়েছে। নির্বাচনের সময় ভোটাররা যাতে একদিক দিয়ে কেন্দ্রে প্রবেশ করে এবং অন্যদিক দিয়ে বের হয়ে যেতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে ভোটার আকৃষ্ট করতে তরুণ ভোটারদের জন্য ভোটকেন্দ্রে আলাদা লাইন করতে হবে। এ ছাড়া আসন্ন দুর্গাপূজায় কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ও নাশকতা যাতে না হয়, এ বিষয়েও জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।

বৈঠকে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের পক্ষ থেকে বলা হয়- বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক সহিংসতা চলছে। এটি মোকাবিলা করা অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়াতে নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্র সচিব, যেন আইনশৃঙ্খলাজনিত যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদেরও সম্পৃক্ত রাখা যায়। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সংক্রান্ত যে কোনো ঘটনা বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ার আগেই এ ব্যাপারে তড়িত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়- রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া একটি দল দেশের বিভিন্ন এলাকায় অরাজক পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে। তারা ভোটের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করতে পারে। এ জন্য নিষিদ্ধ দলের অপতৎপরতা রোধে সর্বোচ্চ সজাগ থাকতে হবে মাঠ প্রশাসনকে। তাদের যে কোনো কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া কঠোর হাতে চাঁদাবাজি দমন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে দেশের কোথাও যাতে কোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়ে মাঠ প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সামাজিক মাধ্যমে কেউ আপত্তিকর বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি দিলে তাৎক্ষণিক সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার দিকে দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে। প্রতিটি পূজাম-পে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের ব্যবস্থা নিতেও বলেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বৈঠকে মব ভায়োলেন্সের বিষয়টিও ওঠে আসে। তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়- যে কোনো ধরনের মব ভায়োলেন্স কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করতে হবে।

নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে সামাজিক মাধ্যম এবং মেসেজিং অ্যাপগুলোয় গুজব, অপতথ্য ও ভুয়া খবর ততই ছড়িয়ে পড়ছে। এ ধরনের অপতথ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কৌশল নির্ধারণ করতেও মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বৈঠকে উপস্থিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, মূলত দুর্গাপূজা সামনে রেখে বৈঠকটি হয়েছে। সেখানে ভোটের বিষয় আলোচনায় গুরুত্ব পায়। এবার তরুণ ভোটারদের জন্য পৃথক বুথের ব্যবস্থা থাকবে- এটা বৈঠকে সবাইকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, ভোটের আগে ভোটকেন্দ্র মেরামতের প্রসঙ্গও এসেছে। বলা হয়েছে, কোন কোন কেন্দ্রের রাস্তাঘাট মেরামতের দরকার, সেই তালিকা দিতে। সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এবার ভোটকেন্দ্রের একদিক দিয়ে ভোটাররা ঢুকবেন, বেরিয়ে যাবেন অন্যদিকে দিয়ে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এটি করা হচ্ছে। ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে থাকবে বডি ওর্ন ক্যামেরা।

একাধিক ডিসি জানান, নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হওয়ায় ডিসির ওপর নির্বাচনের দায় বর্তায়। কিন্তু মাঠপর্যায়ে পেশিশক্তির প্রভাব অনেক বড় ইস্যু। ইউএনওসহ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা খবর পেলে ঘটনাস্থলে ছুটে যান। কিন্তু প্রতিটি ভোটকেন্দ্র অবাধ ও স্বচ্ছ করতে বডি ওর্ন ক্যামেরা ও পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ জনবলের প্রয়োজন। একইভাবে পুলিশের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের শুধু স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নয়, ভোটকেন্দ্রের অপরাধ দমনের ক্ষমতা দেওয়ার ওপরও তারা গুরুত্বারোপ করেন।

শিল্পাঞ্চল সমৃদ্ধ ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলার একজন ডিসি বলেন, নির্বাচনের আগে শ্রমিক অসন্তোষের মতো ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি অশান্ত করতে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়। এ প্রেক্ষিতে গার্মেন্ট মালিক ও শ্রমিক নেতাদের মতাদর্শ সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত যেন কোনোভাবেই উসকানি দিয়ে দেশকে অশান্ত করতে না পারে।

চট্টগ্রাম বিভাগের একজন জেলা প্রশাসক জানান, সীমান্ত এলাকার উপরও নজরদারি বাড়ানো উচিত। প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিরীহ মানুষকে অর্থের বিনিময়ে নাশকতার কাজে যুক্ত করার চেষ্টা করতে পারে দুষ্কৃতিকারীরা। সন্ত্রাসমূলক কর্মকা- রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি রাজনীতিবিদদেরও দায়িত্ব আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডিসি জানান, মাঠ প্রশাসনে বড় সমস্যা রাজনৈতিক দলগুলোর গ্রুপিং। একই দলের একাধিক নেতা তাদের অনুসারীদের বাড়তি সুবিধা দিতে চাপ প্রয়োগ করেন। নিজের অবস্থান শোডাউন করতে গিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে হানাহানির সূত্রপাতও ঘটে। সামনের দিনগুলোয় পেশিশক্তির ব্যবহার বাড়তে পারে। রাজনৈতিক সহিংসতা এড়াতে জিরো টলারেন্স নীতির ব্যাপারে আলোচনা হয় সভায়।

নির্বাচন বানচাল করতে একটি চক্র অপচেষ্টা শুরু করেছে- এমন আলোচনাও হয়েছে। এ জন্য সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে স্থানীয় সমাজপতিদের নিয়ে বৈঠকের গুরুত্বারোপ করা হয়।

ভোটের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে শুধু ভোটের দিনই নয়, এখন থেকেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দরকার। কারও প্রতি বিশেষ অনুকম্পা দেখানোর চেষ্টা করলে নির্বাচন বিতর্কিত হতে পারে। তাই তাগিদ দেওয়া হয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার আভাস পেলে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার প্রসঙ্গ উঠে আসে সভায়।