
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানপরবর্তী সময় রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন করতে পারা নিয়ে দেখা দিয়েছে বড় অনিশ্চয়তা। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর), নতুন সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদ নির্বাচন ও সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় ব্যবধানে অনৈক্য দেখা দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত এই সনদে সংশ্লিষ্ট সব রাজনৈতিক দলের সই করা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সনদ প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নিজেই সব দলের সই নিয়ে সনদ চূড়ান্ত করতে পারা নিয়ে আশা-নিরাশার দোলাচলে পড়েছে। চলতি সপ্তাহে সনদের চূড়ান্ত রূপ নির্ধারণের ইচ্ছা থাকলেও কমিশন তা করতে পারেনি।
দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রবিবার প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেছেন, পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উভয় কক্ষের নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের কথা বলেছেন তারা। পরদিন দলের আমিরের সঙ্গে বৈঠকেও জামায়াত পিআর পদ্ধতির পক্ষে দলের দৃঢ় অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়। রবিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আগামী নির্বাচনই যাতে গণপরিষদ নির্বাচন হয়, সেই দাবি জানিয়ে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছে।
চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে পিআর পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচনের কথা বলেছে। দলটির দাবি, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ দলই পিআর পদ্ধতির পক্ষে। একই সঙ্গে নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের বাস্তবায়নও চায় দলটি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে এসব কথা বলা ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ও বক্তব্য-বিবৃতিতেও জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন এমনো বলেছে, তাদের এসব প্রস্তাব মেনে নেওয়া না হলে জুলাই সনদে তারা সই করবে না। জামায়াত চায় গণভোট বা রাষ্ট্রপতির প্রোক্লেমেশনের (ঘোষণা) মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন করা হোক।
তবে, বিএনপি শুরু থেকেই পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেওয়া দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, পিআর পদ্ধতি সংবিধানে নেই। এটা বাংলাদেশের জন্য এখনো উপযোগী নয়। যে দেশের মানুষ ইভিএম পদ্ধতিই এখন পর্যন্ত বুঝতে পারেনি, তারা কীভাবে পিআর বুঝবে। কিছু দল নিত্যনতুন প্রস্তাব সামনে এনে নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে বলেও অভিযোগ করেন সালাহউদ্দিন।
জানা গেছে, সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে দলটির নেতারা বলেছেন—পিআর, গণভোট ও নতুন সংবিধানের কথা বলে যারা নির্বাচন বিলম্বিত কিংবা বানচালের চেষ্টা করবে। তাদেরকে
রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা হবে। সংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো আগামী সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়নের পক্ষে বিএনপি। বিএনপির পাশাপাশি এলডিপি, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট এবং বামপন্থি কয়েকটি দলও পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে।
ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার গতকাল বুধবার ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘সনদের ভাগ্য নির্ভর করছে মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। সনদে সবার সই করা এবং এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য সৃষ্টিতে দলগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে।’
জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত ও বাস্তবায়নের উপায় বিবেচনা করতে গতকালও সভা করেছে ঐকমত্য কমিশন। সংসদ ভবনে কমিশন কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এই সভায় সনদ চূড়ান্ত করা এবং বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি নির্ধারণে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত পরামর্শ ও সুপারিশমালা পর্যালোচনা করা হয়। গতকালও কয়েকটি দল এবিষয়ে মতামত জমা দিয়েছে। এসব মতামত বিবেচনায় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আবারও বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার সভায় উপস্থিত ছিলেন।
কমিশন জানায়, জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করতে ইতিমধ্যে ২৮টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে সভা করেছে ঐকমত্য কমিশন। এই প্রক্রিয়ায় কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে মতামত আহ্বান করে। এপর্যন্ত ২৬টি দল মতামত জমা দিয়েছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গতকাল ছাড়াও সোমবার ১৭টি এবং আগের দিন আটটি দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করে কমিশন। এর আগে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গেও কমিশনের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে।
ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে, জুলাই সনদের বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আবারও বৈঠক করবে কমিশন। বৈঠকের পর সনদের একটি চূড়ান্ত রূপ নির্ধারণ করে তা শেষ বারের মতো রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠানো হবে। তবে, সেক্ষেত্রে দলগুলোর কাছ থেকে নতুন করে আর কোনো মতামত নেওয়া হবে না। এরপর দুই পর্বের আনুষ্ঠানিক সংলাপে ও পরে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ৩০টি রাজনৈতিক দল-জোটকে সনদে সই করার আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি ‘স্বাক্ষর অনুষ্ঠান’ আয়োজনের চিন্তা করছে কমিশন। তাতে সই করবে কি-না, কিংবা কোন দল করবে, কোন দল করবে না—সেটা দলগুলোর সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, জুলাই সনদ তথা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে, তা জুলাই সনদে উল্লেখ থাকছে না। রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আলাদা সুপারিশ তুলে ধরবে কমিশন। বাস্তবায়ন পদ্ধতি জুলাই সনদের অংশ হবে না।
প্রসঙ্গত, গত ২৯ জুলাই ৩০টি দলকে জুলাই সনদের একটি প্রাথমিক খসড়া দিয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। প্রাথমিক খসড়া নিয়ে দলগুলোর মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে ‘পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া’ তৈরি করে ১৬ আগস্ট দলগুলোকে দেওয়া হয়। এটি নিয়ে ২৯টি রাজনৈতিক দল তাদের মতামত দিয়েছে। পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত এই খসড়ায় অঙ্গীকারনামায় থাকা সনদকে সংবিধানের ওপর স্থান দেওয়া, সনদ নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তুলতে না পারার প্রস্তাব নিয়ে ঘোর আপত্তি তুলেছে বিএনপিসহ এর সমমনা দল-জোটগুলো।
চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি গঠিত হওয়া ছয় মাস মেয়াদি ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল গত ১৫ আগস্ট। ঐদিনই কমিশনের মেয়াদ আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এই সময় আর বাড়ানোর পক্ষে নয় কমিশন। রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সনদের চূড়ান্ত রূপ নির্ধারণ করে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই সই করিয়ে কমিশন নিজেদের দায়িত্ব শেষ করতে চায়।