
গুম জীবনের ভয়ংকর প্রায় ৭ মাসের সেই দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা মনে করে এখনো মাঝে মাঝে আঁতকে ওঠেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হুম্মাম কাদের চৌধুরী। বাইরের আলো-বাতাসহীন ছোট্ট একটি কুঠুরি যা আয়নাঘর হিসাবে পরিচিত সেখানেই তাকে রাখা হয়েছিল। দীর্ঘ প্রায় ৭ মাসে কখন সকাল এসছে কখন দুপুর কিংবা রাত পার হয়েছে তা জানতেও পারতেন না। রুটি, ভাত-সবজি মাঝে মাঝে এক টুকরো মাংস দেওয়া হতো খাবারে। ফ্যাসিস্ট সরকার তাকে তুলে নিয়ে আয়নাঘরে বন্দি করেছিল ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট। সেখান থেকে ছাড়া পান ২০১৭ সালের ২ মার্চ। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ডিবি পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ ৭ মাস একা ঘরে রাখা হয়। সেখানে প্রায়ই গোয়েন্দারা আসতেন, দেখাতেন ভয়ভীতি, চালানো হতো নির্যাতন, হুমকি দেওয়া হতো শেষ করে দেওয়ার। এসব কারণে সারাক্ষণ মৃত্যুভয় তাড়া করত। যেদিন গোয়েন্দারা তাকে ধানমন্ডির বাসার কাছে নামিয়ে দিয়ে আসেন, সেদিনও মনে হয়েছে তাকে হত্যা করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু না, তাকে হত্যা করেনি। তবে মুক্তির সেই দিনটি তার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বড় ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী।
গুম জীবনের করুণ কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে হুম্মাম কাদের চৌধুরী বলেন, তাকে ঢাকা সিএমএম কোর্টের সামনে থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যান গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। এক রাত মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে রাখার পর নেওয়া হয় ভয়ংকর আয়নাঘরে। যে আয়নাঘরের চওড়া তিন কদম আর দৈর্ঘ্য ৯ কদমের মতো। বাইরের কোনো আলো-বাতাস প্রবেশ করত না। একটি লাইট জ্বালানো থাকত। রুটি দিলেই বুঝতে পারতেন সকাল হয়েছে। এরপর ভাত দিলে দুপুর, তারপর ভাত দিলে রাত হয়েছে বলে ধারণা নিয়েই কেটেছে ৭ মাস। ভাতের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় সবজি, কখনো কখনো গোয়েন্দাদের মুড ভালো থাকলে এক টুকরো মাংস দিত। একটি কার্পেট চৌকি, একটি বালিশ দেওয়া হয়েছিল। কখনো শুয়ে-কখনো বসে ঘুমাতেন। বেশির ভাগ সময় নামাজ পড়তেন। প্রথম প্রথম ঘুম না এলেও পরে মানিয়ে নেন। ওই কক্ষে ওয়াশরুম ছিল না। হাত-মুখ বেঁধে কক্ষের বাইরে ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়া হতো কড়া পাহারায়। সব সময় ভাবতেন তিনি এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবেন তো। নাকি ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে। বাইরে বের করলেই মনে হতো ক্রসফায়ারের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বাঁচলে মায়ের কাছে, মরলে শহীদ বাবা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কাছেই পৌঁছে যাবেন এই ছিল ভাবনা।
তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল পরিবারের কথা জানতে চাওয়া। অনেকদিন পর একবার গোয়েন্দাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, তার পরিবার কেমন আছে, ভালো আছে তো। প্রতিউত্তরে বলা হয়, তারা বাসায় আছেন বা ভালো আছেন-এটা কিভাবে ভাবতে পারলেন। তারাও তো আপনার মতো পাশেই কোনো সেলে বন্দি আছে এমনও তো হতে পারে। তখন মনটা ভারী হয়ে যায় হুম্মামের। ভাবতে থাকেন তাহলে তার পরিবারকেও কী তার মতো টর্চার করা হচ্ছে। আয়নাঘরে বন্দি করা হয়েছে।
হুম্মাম কাদের বলেন, এক সময় মানুষ বিশ্বাস করেনি আয়নাঘর বলে কিছু আছে। অথচ গুম কমিশন তা প্রমাণ করেছে। তিনি নিজেই এর ভুক্তভোগী। তার পাহারায় থাকা আয়নাঘরের একজনের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি বেঁচে ফিরতে পারবেন তো। তখন তাকে বলা হয়, ফিরতেও পারেন, নাও পারেন। আয়নাঘরে কতদিন রাখা হয় এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ৭-৮ বছরও রাখা হয়। তার কাছের মানুষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজমি ও আরমানকে ৮ বছর ধরেই আয়নাঘরে আটকে রাখার তথ্যও পরে জানতে পারেন। তখন ভাবেন তার তো ভাগ্য ভালো। ৭ মাসেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। হুম্মাম বলেন, বিগত ১৬ বছর দেশে আইনের শাসন বলে কিছুই ছিল না। শুধু ভিন্নমতের রাজনীতি করার কারণে তার মতো অসংখ্য মানুষকে আয়নাঘরের মতো ভয়ংকর বন্দিশালায় বছরের পর বছর আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করেছে হাসিনা সরকার।
গুমের মতো অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদন হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হুম্মাম বলেন, এই আইন কার্যকর হলে আগামীতে আর কেউ এভাবে নির্যাতনের পথ বেছে নেবে না। এটি দ্রুত কার্যকর করা উচিত। একই সঙ্গে বিগত সরকারের আমলে যারা আয়নাঘর সৃষ্টি করে জঘন্যতম নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছিল তাদের চিহ্নিত করে এই আইনে বিচার করতে হবে।
হুম্মাম কাদের চৌধুরী রাঙ্গুনিয়ায় দলের জন্য কাজ করছেন। সেখান থেকেই তিনি বিএনপির মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে জানা গেছে।