Image description
 

গ্রাহকের আমানত ঠিকমতো ফেরত দিতে না পারলেও ঢাকার বাইরে কোটি টাকার বেশি খরচ করে জমকালো ব্যবসায়িক সম্মেলন করতে চায় শরিয়াহ্ভিত্তিক সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল)। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় অনুমোদন করা হয়। তবে আর্থিক সংকটের মধ্যে এমন আয়োজনের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরিবর্তে ঢাকায় সীমিত পরিসরে ব্যাংকের নিজস্ব অবকাঠামোর মধ্যে সম্মেলন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। মূলত ব্যাংকের খরচ কমিয়ে আনতে এই পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংশ্লিস্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে যে কয়টি ব্যাংকে ব্যাপক লুটপাট হয়, তার মধ্যে অন্যতম এসআইবিএল। বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকাকালে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়। এতে দীর্ঘদিন ধরেই তারল্য সংকটে ভুগছে ব্যাংকটি। আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়াসহ দৈনন্দিন কার্যক্রম চালাতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়মিত ধার করে চলতে হচ্ছে। এ অবস্থাতেই পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সবচেয়ে বিলাসবহুল ফাইভ স্টার হোটেলে (বে-ওয়াচে) ২০২৫ সালের বার্ষিক ব্যবসায় সম্মেলন আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় এসআইবিএল। আগামী ১৭ ও ১৮ জানুয়ারি এই সম্মেলন আয়োজনে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা খরচের প্রাক্কলন করে গত ১২ ডিসেম্বর ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় প্রস্তাব পাশ করা হয়। ২৭০ জনের জন্য ভ্যাটবাদে এই খরচের প্রাক্কলন করা হয়। ভ্যাটসহ এই খরচ আরও বেশি হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ওই সভার মেমো অনুমোদনের জন্য পাঠানোর পরই নাকচ করে দেওয়া হয়। এর পরিবর্তে ঢাকায় সীমিত পরিসরে নিজস্ব ট্রেনিং ইনস্টিটিউশন বা কনফারেন্স রুমে

আয়োজনের পরামর্শ দিয়ে গত সপ্তাহে ব্যাংকটিতে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, খরচ তুলনামূলক বেশি হওয়ায় ঢাকার বাইরে সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব নাকচ করা হয়েছে। পরিবর্তে ঢাকায় নিজস্ব অবকাঠামোর মধ্যে আয়োজনের পরামর্শ দেওয়া হয়। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে ঢাকার বাইরে গিয়ে পিকনিক স্টাইলে জমকালো ব্যবসা সম্মেলনের যৌক্তিকতা নেই। এ ধরনের প্রস্তাব পর্ষদে পাস করাটাই যুক্তিসঙ্গত হয়নি। সীমিত পরিসরে জুমেও এ ধরনের অনুষ্ঠান করা যায়।

পর্ষদে এ প্রস্তাব যখন পাস করা হয়, তখন ব্যাংকটির ভারপ্রাপ্ত এমডি ছিলেন মোহাম্মদ ফোরকানউল্লাহ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘ঢাকার বাইরে সম্মেলন আয়োজনের সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে স্থগিত করা হয়েছে। এর বেশি কিছু জানি না।’ সংকটের মধ্যেই ঢাকার বাইরে এত টাকা খরচের প্রস্তাব বোর্ডে তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘এটা সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত ছিল।’

এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম সাদিকুল ইসলামের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। এ ছাড়া মোবাইলে এসএমএস পাঠালেও সাড়া দেননি। পরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মাকসুদা বেগম আমাদের সময়কে বলেন, ‘সাময়িকভাবে সম্মেলনটি স্থগিত করা হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যে পরামর্শ এসেছে, সে অনুযায়ী সম্মেলনটি করাও কঠিন। এখন ঢাকার মধ্যে কোনো ভেন্যুতে করতে হবে। কারণ ব্যাংকের পৃথক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট নেই। ট্রেনিংয়ের জন্য একটা মাত্র রুম আছে, যেখানে ৩০ জন বসতে পারে। আর যে কনফারেন্স রুম আছে, সেখানেও সর্বোচ্চ ৩০-৩৫ জন বসতে পারবে। নতুন এমডি যোগদানের পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। ব্যাংকের আর্থিক সংকটের মধ্যে কেন এমন প্রস্তাব কেন পাস করা হলো- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রথম যখন প্রস্তাবটি বোর্ডে এসেছিল, তখন খরচ কমাতে ঢাকার বাইরে করতে নিষেধ করেছিলাম। পরে রাজধানীতে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে দেখা গেল ভেন্যু পাওয়া কষ্টকর এবং সেগুলো খুব ব্যয়বহুল। কক্সবাজারের ওই ভেন্যুতে ঢাকার চেয়ে খরচ কম পড়ছিল। এ ছাড়া বড় ধরনের ডিসকাউন্টও পাওয়া গেছে। এ কারণে ওই ভেন্যু ঠিক করে পর্ষদ সভায় প্রস্তাব পাস করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি বছরই জমকালোভাবে বার্ষিক ব্যবসা সম্মেলন করে আসছে ব্যাংকটি। গত বছরও কক্সবাজারের একটি রিসোর্টে দুই দিনব্যাপী সম্মেলন করা হয়েছিল। ওই আয়োজনেও বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করা হয়। তার আগের বছরও কক্সবাজারের সিকদার রিসোর্টে করা হয়। তখন ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ ছিল চট্টগ্রামের বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের হাতে। ২০১৭ সালে এই গ্রুপ ব্যাংকটি দখলে নেওয়ার পর থেকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ টাকা বের করে নেয়। এতে ব্যাংকটি চরম আর্থিক সংকটে পড়ে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে রক্ষিত চলতি হিসাবে ঘাটতির সম্মুখীন হয়। এরপরও সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকের সব ধরনের লেনদেনের সুযোগ করে দেন। গত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নিয়েই আগের সব অবৈধ সুবিধা বন্ধ করে দেন। এতে ব্যাংকটির আসল চিত্র বেরিয়ে আসে। সেই সঙ্গে এস আলমকে সরিয়ে ব্যাংকটির পর্ষদ পুনর্গঠন করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে আস্থা সংকটের পড়ে ব্যাংকটি থেকে নগদ টাকা তোলার চাপ বাড়ে। এমন পরিস্থিতিতে গত সেপ্টেম্বরে তারল্য সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে তহবিল পেতে গ্যারান্টি পদ্ধতি চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে আন্তঃব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকার বেশি ধার পায় ব্যাংকটি। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়েও সহায়তা করা হয়। এতে ব্যাংকটির প্রতি মানুষের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। এখন আমানতকারীরা আগের চেয়ে বেশি অর্থ তুলছে পারছেন।