
নিয়োগ পরীক্ষার জালিয়াতিতে প্রশ্ন ফাঁস, প্রক্সি পরীক্ষার্থী, ডিভাইস ব্যবহারের কথা শোনা গেলেও জীবন বীমার ক্ষেত্রে ‘অভিনব’ পদ্ধতি দেখতে পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক।
সংস্থাটি বলছে, বছর চারেক আগে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় বহুনির্বাচনি বা এমসিকিউ প্রশ্ন এমনভাবে করা হয়, যাতে একটি সূত্র অনুযায়ী উত্তর দিতে পারেন পছন্দের প্রার্থীরা। সেই সূত্রটি হচ্ছে- যে প্রশ্নের ক্রমিক নম্বরের শেষ সংখ্যা ২, ৭ বা ০ (শূন্য), তার উত্তর হবে ‘ক’। যে প্রশ্নের ক্রমিক নম্বরের শেষ সংখ্যা ১ অথবা ৫, তার উত্তর ‘খ। যে প্রশ্নের ক্রমিক নম্বরের শেষ সংখ্যা ৪, ৮ বা ৯- তার উত্তর হবে ‘গ’। যে প্রশ্নের ক্রমিক নম্বরের শেষ সংখ্যা ৩ অথবা ৬, তার উত্তর হবে ‘ঘ’।
এ সূত্র মেনে ২০২১ সালের ২৫ অগাস্ট উচ্চমান সহকারী এবং অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পরীক্ষা নেওয়া হয়। একই নিয়ম মেনে পরদিন নেওয়া হয় অফিস সহায়ক পদের পরীক্ষা। এরপরই উত্তর ফাঁস করে বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
দুর্নীতি মোকাবিলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাটি বলছে, অভিনব পদ্ধতিতে নিয়োগ জালিয়াতি চেষ্টার হোতা হচ্ছেন জীবন বীমা করপোরেশনের তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহুরুল হক এবং প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম। তাদের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি মামলা করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নুর আলম সিদ্দিকী।
তদন্ত শেষে গত ৪ ফেব্রুয়ারি জহুরুল ও মাহবুবুলের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে দুদকের সহকারী পরিচালক আশিকুর রহমান। মামলাটি ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল জজ এস এম জিয়াউর রহমানের আদালতে বিচারাধীন।
অভিযোগ গঠনের বিষয়ে গত ১১ অগাস্ট শুনানি হওয়ার কথা ছিল। তবে দুদকের তরফে কৌঁসুলি নিয়োগ না করায় শুনানির জন্য আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর দিন ঠিক করা হয়েছে।
আদালতের বেঞ্চ সহকারী আরিফুল ইসলাম বলেন, “দুদকের পক্ষে এ মামলায় কে শুনানি করবেন তা এখনো নিয়োগ হয়নি। এ কারণে মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি হচ্ছে না। দুদকের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ হলেই শুনানি হবে।”
তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক আশিকুর রহমান বলেন, “জীবন বীমা করপোরেশনের (সাবেক) এমডি জহুরুল হক এবং (তখনকার) সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসন) মাহবুবুল আলম নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ক্রমবিন্যাস সন্নিবেশ করে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের উত্তর জানিয়ে দিতেন। অভিনব এ পন্থা দুদকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। তাদের দুইজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।”
অভিযোগপত্রের বিবরণ অনুযায়ী, জহুরুল হক জীবন বীমা করপোরেশনের দায়িত্ব নেওয়ার পর নিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হয়। আগে এমসিকিউ পরীক্ষার পর লিখিত পরীক্ষা গ্রহণের বিধান থাকলেও নতুন নীতিমালায় এমসিকিউ পরীক্ষাকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে’ লিখিত পরীক্ষার সমমান হিসেবে ঠিক করা হয়। এরপর আহসানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে সহায়তাকারী হিসেবে রেখে নিজেরা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরীক্ষা গ্রহণ করে জীবন বীমা করপোরেশন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, এমসিকিউ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ সফিউল আলম সাধারণ জ্ঞান বিষয়ে প্রশ্ন প্রণয়ন করেন। পরিচালক (উপসচিব) শাহ আলম প্রশ্ন তৈরি করেন বাংলা বিষয়ে, প্রশাসন বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার (উপসচিব) শেখ কামাল হোসেন প্রশ্ন তৈরি করেন গণিত বিষয়ে। এছাড়া পিএসসির উপপরিচালক জামিলা শবনম ইংরেজি বিষয়ে প্রশ্ন ঠিক করেন।
তদন্ত কর্মকর্তা আশিকুর বলেন, তারা নিজেদের হাতে লেখা প্রশ্ন দাখিল করেন নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক, জীবন বীমার তখনকার এমডি জহুরুল হকের কাছে। তার নির্দেশনা মোতাবেক কম্পিউটারে প্রশ্নপত্র কম্পোজ করেন তৎকালীন সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসন) মাহবুবুল আলম। এসব প্রশ্নপত্র যাচাইয়ের জন্য দেওয়া হলে প্রশ্ন প্রণয়নকারী চারজনই দেখতে পান, প্রশ্নের উত্তরের ধরন পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এ বিষয়ে তারা প্রশ্ন তুললে জহুরুল হক তখন বলেছিলেন, পরীক্ষায় অধিকতর ‘স্বচ্ছতা ও গোপনীয়তা’ রক্ষার্থে সঠিক উত্তরের ঘর পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। তার কথায় সন্তুষ্ট হয়ে খসড়া প্রশ্নপত্রে সই করেন প্রশ্ন প্রণয়নকারীরা।
চার প্রশ্নকারীর সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট বক্তব্য, মতামত এবং নথি ও তথ্য প্রমাণ বিশ্লেষণ করে তাদের কোনো ‘অসৎ উদ্দেশ্য’ দেখতে পায়নি দুদক।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নের কক্ষটি ছিল খুবই সুরক্ষিত; পরীক্ষা কমিটির ছয় সদস্য বাদে অন্য কারো প্রবেশের সুযোগ ছিল না। আহ্বায়ক প্রশ্নকারী চারজনকে নির্ধারিত সংখ্যার অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ প্রশ্ন করার পরামর্শ দেন। ফলে হাতে লেখা খসড়ায় অধিক প্রশ্ন ছিল।
দুদক জেনেছে, কম্পোজ করা খসড়া প্রশ্নসহ গোপনীয় কাগজপত্র একটি খামে, চূড়ান্ত প্রশ্নপত্র একটি খামে এবং কম্পোজ কাজে ব্যবহৃত ল্যাপটপ পৃথক খামে সিলগালা অবস্থায় আহ্বায়কের কক্ষে সংরক্ষণ করা হয়। পরীক্ষা কমিটির আহ্বায়ক তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে টাইপ করা খসড়া প্রশ্নপত্র উপস্থাপন করলেও হাতে লেখা খসড়া প্রদর্শন করেননি।
তদন্ত কর্মকর্তা আশিকুর বলেন, “ওই খসড়া ধ্বংস করা হয়েছে বলে তিনি লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। কারণ হাতে লেখা খসড়া প্রদর্শন করা হলে তার উত্তরপত্রের প্যাটার্ন পরিবর্তন সংক্রান্ত কারসাজি করার বিষয়টি প্রমাণিত হবে।
“জহুরুল হক পূর্ব পরিকল্পিতভাবে নিজ দায়িত্বে প্রশ্নপত্রের প্যাটার্ন পরিবর্তন করে নিজের মত সন্নিবেশ করেন এবং সদস্য সচিব মাহবুবুল আলম তাকে সহযোগিতা করেন। মূলত অবৈধ সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে তিনটি পদের প্রশ্নের উত্তর পছন্দের প্রার্থীদের জানিয়ে দেন।”
জানতে চাইলে জহুরুল হকের আইনজীবী বাবুল মিয়া বলেন, “দুদক মামলা করেছে। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র এসেছে। মামলাটি অভিযোগ শুনানির পর্যায়ে রয়েছে। আমরা তার অব্যাহতি চেয়ে শুনানি করব।
“আশা করছি, তিনি অব্যাহতি পাবেন। এর পরও যদি অভিযোগ গঠন হয়ে যায়, আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে তাকে নির্দোষ প্রমাণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”
মাহবুবুল আলমের আইনজীবী শাখাতুল ইসলাম ভূঁইয়ার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ব্যস্ত আছেন; পরে যোগাযোগ করবেন।