Image description

গত ১৩ আগস্ট দুপুর সাড়ে ১২টায় ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের দ্বিতীয়তলার প্রবেশপথের এক কোনায় হাতকড়া পরা এক আসামিকে ঘিরে এক স্বজন ও এক পুলিশ সদস্য। তাদের মধ্যে কথা হচ্ছে চাপা গলায়। কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, আসামির স্বজন পুলিশের হাতে কিছু নোট গুঁজে দিয়েছেন। কিছুক্ষণ পর আসামির বড় ভাই রাজমিস্ত্রি আবদুল কাদের (৪০) এ প্রতিবেদককে জানান, মিরপুর ১১ নম্বর কাঁচাবাজার থেকে এসেছেন। ছোট ভাই তৈয়বুর রহমান জনি (৩৮) ২০০৭ সালের একটি ডাকাতি মামলায় কয়েক মাস কারাগারে থেকে জামিন পেয়েছে। মামলা চলছে। গত বছর এপ্রিল থেকে হাজিরা না দেওয়ায় তৈয়বুরকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি হয় ও সে গ্রেপ্তার হয়। আব্দুল কাদের বলেন, ‘সকালে কারাগার থেকে নিয়া আসছে। সারাদিন না খাইয়া থাকব। ২০০ ট্যাকা দিলাম, যাতে খাওন কিন্যা দেয়। ম্যালা দিন থেইক্যা এই যন্ত্রণা টানতেছি। যা কামাই করি কোর্টে আইস্যা শেষ।’

আদালতপাড়ায় বিচারাকাক্সক্ষী ও আইনজীবীদের কাছে অতি পরিচিত কথাÑ ‘কিছু দ্যান’। এ কথার অর্থ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, মামলার শুরু থেকে বিচারের রায় পাওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন দপ্তরে থাকা একশ্রেণির অসাধু কর্মচারী ও পুলিশকে খুশি করতে দিতে হয় ঘুষ। ঘুষের আরেক নাম ‘বাড়’। যারা ‘কিছু দ্যান’ এ অনৈতিক কথা মেনে চলেন তাদের কাজ হয় দ্রুত। আর যারা এ কথা মানেন না, তাদের কাজ হয় শ্লথগতিতে। মামলা চালাতে গিয়ে আইনজীবীদের ‘ফি’র পাশাপাশি আরও কিছু যেমন ‘খরচ’, ‘বকশিশ’, ‘চা-নাশতা’, ‘মিষ্টি’, ‘লাঞ্চ’, ‘বিরিয়ানি’, ‘পান খরচ’ প্রভৃতির জন্যও প্রস্তুত থাকতে হয় বিচারাকাক্সক্ষীকে; যদিও তাদের বেশিরভাগই গরিব লোক। অনেকে ঋণ বা কর্জ করে এসব ‘খরচ’ সামাল দেন।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেশ রূপান্তরের এ প্রতিবেদক ঢাকার আদালত এলাকায় নিয়মিত আইনপেশায় আছেন এমন নয়জন আইনজীবী ও বেশ কয়েকজন বিচারসংশ্লিষ্ট লোকের সঙ্গে কথা বলেছেন। সরেজমিন কয়েকটি দপ্তরের কার্যক্রমও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। আইনজীবীরা প্রায় অভিন্ন সুরে বলেছেন, আদালত অঙ্গনে এটা-সেটার নামে দুর্নীতি বা ঘুষের লেনদেন প্রায় গা-সওয়া হয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে তা অত্যাচারের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। কিছুদিন আগেও ২০, ৫০, ১০০ টাকায় যে কাজ হতো, সে কাজের জন্য এখন ১০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে হয় বিচারাকাক্সক্ষীকে। মামলার ‘গুরুত্ব’ অনুযায়ী টাকার পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আইনজীবীর ফি তো আছেই, আইনজীবীর সহকারী, পেশকার, অফিস সহকারী, নকল শাখা ও পুলিশদের খুশি করার ‘ফি’ও দিতে হয়।

উত্তরায় সমন যেতে খরচ ৪ হাজার টাকা: গত ৩০ জুলাই ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ আদালত-১ একটি দেওয়ানি মামলায় বিবাদীর উদ্দেশে সমন জারি করে। উত্তরায় ৬ নম্বর সেক্টরে একটি ছয়তলা ভবনে থাকা বেসরকারি একটি হাসপাতালের কাছে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ভাড়া বাবদ ১ কোটি ৩৪ হাজার টাকার দাবিতে মামলা করেন ওই ভবন মালিক। সরকারিভাবে সমন পাঠানোর নিয়ম থাকলেও জারিকারক উত্তরায় সেটা পাঠাতে ৪ হাজার টাকা দাবি করেন। শুরু হয় দরকষাকষি। বাদীপক্ষ শেষ পর্যন্ত ২ হাজার টাকায় রফা করে। এ প্রতিবেদক বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন বাদীর আইনজীবী সোলায়মান তুষারের সঙ্গে। বিচারাধীন মামলাটির নথি পাঠাতে বিলম্ব হতে পারে এমন আশঙ্কায় ওই আইনজীবী বাদী, বিবাদী কিংবা জারিকারক কারও নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন। ব্যারিস্টার সোলায়মান তুষার বলেন, ‘গত বছর ৫ আগস্টের পর কিছুদিন আদালত অঙ্গনে অনৈতিক লেনদেন তেমন হতো না। কয়েক মাস পরেই পরিস্থিতি খুব বাজে হয়ে দাঁড়ায়। সমন যাবে না, মামলা বিলম্বিত হবে এসব কথা শুনে অনৈতিক আবদার মেনে নিতে হচ্ছে।’ তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘এর জন্য দায়ী একশ্রেণির আইনজীবী। বিচারপ্রার্থীর কাজ দ্রুত করতে এমন আবদার মেনে নেওয়া হয়, টাকাটা কিন্তু বিচারপ্রার্থীর পকেট থেকেই যায়।’

১৭ ধাপে অনৈতিক লেনদেন : দেওয়ানি, ফৌজদারি ও অন্য মামলায় বিচার পেতে বিচারপ্রার্থীকে অন্তত ১৭টি ধাপে ঘুষ দিতে হয়। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আদালতের পেশকার, অফিস সহকারী, নকল শাখার কর্মচারী, জারিকারক ও পুলিশের বিরুদ্ধে। মামলার গুরুত্ব ও বিচারপ্রার্থীর আর্থিক অবস্থান ভেদে লেনদেন হয় একেক রকম। দেওয়ানি মামলায় ফাইলিং, নোটিস জারি, জবাব দাখিল, ইস্যু গঠন, সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ, চূড়ান্ত শুনানি বা দুপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ, রায়, আপিল, রিভিশন, ডিক্রি সবক্ষেত্রেই আদালতসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের খুশি করতে হয়। এটি নির্ভর করে মামলার স্বত্বমূল্য কত তার ওপর।

ফৌজদারি মামলা শুরু করতে (ফাইলিং) হয় আদালতের পেশকার-পিয়নদের খুশি করে। বিচার পেতে মামলা করেন যিনি, তিনিও রেহাই পান না এ নজরানা থেকে। জামিনের দরখাস্ত দিতে ৫০ থেকে ৫০০, জামিননামা দাখিল করতে সংশ্লিষ্ট থানার জিআরও শাখায় ২০০ থেকে ১ হাজার, মামলার রায় ও আদেশের নকল পেতে ২০০ থেকে শুরু করে কয়েক হাজার, হাজিরায় ১০০ থেকে ৩০০, নম্বর ধরে মামলার ফাইল খুঁজতে ৫০ থেকে ২০০ (পুরনো ফাইল হলে টাকার অঙ্ক বাড়ে), জিআরও শাখায় বিভিন্ন থানার ফাইল খুঁজতে ২০০ থেকে ৫০০, জামিননামা কারাগারে পাঠাতে মামলার গুরুত্ব ভেদে ৩০০ থেকে ১ হাজার, হাজতখানা থেকে ওকালতনামায় আসামির স্বাক্ষর নিতে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা দিতে হয়। এমনকি বিচারপ্রার্থীর আইনজীবীর চাহিদা অনুযায়ী মামলার তারিখ এগিয়ে বা পিছিয়ে নিতেও ঘুষ দিতে হয় বলে জানান কয়েকজন আইনজীবী। পেশকাররা এ লেনদেনে অভ্যস্ত। এ ছাড়া গ্রেপ্তার হওয়া আসামির স্বজনদের সঙ্গে কথা বলা, একবেলা খাবার খাওয়াতে একশ্রেণির মধ্যস্থতাকারী (দালাল) ও পুলিশকে ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হ

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার ঢাকার আদালতে নিয়মিত দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা করেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, “কয়েক বছর আগেও পুলিশ, পেশকার, পিয়ন, আরদালিরা বিনয়ের সঙ্গে বলত, ‘স্যার খুশি হইয়া যাই দেন’। এখন এটি অত্যাচারের পর্যায়ে পৌঁছেছে। ঘুষ না দিলে নথি নড়ে না। চুরির মামলায় জামিন হলেও আদালতের দরজার সামনে কয়েকজন এসে বকশিশের জন্য হাত বাড়িয়ে দেন। দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।”

নকল শাখায় প্রকাশ্যে লেনদেন : ২০২৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অধস্তন আদালতে দুর্নীতি রোধে মামলার নথির ফটোকপি সরবরাহ বন্ধ হয়েছে। এখন সার্টিফায়েড কপি তুলতে হয় বিচারপ্রার্থীকে। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন আদালতের নকল শাখার একশ্রেণির কর্মচারী। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের নকল শাখায় ঘুরে দেখা গেছে, প্রকাশ্যেই চলে ঘুষের লেনদেন। ১৩ আগস্ট দুপুরে এক আইনজীবীকে নকল শাখার এক ব্যক্তিকে ৫০০ টাকা ঘুষ দিতে দেখা গেছে। শাখা থেকে বেরোনোর পর অ্যাডভোকেট সাদ্দাম হোসেন নামের আইনজীবীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘ফৌজদারি মামলার একটি আদেশের অনুলপি তুলতে পাঁচ পাতায় ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে। অথচ নির্ধারিত খরচ প্রতি পাতায় ১২ টাকার মতো।’ একাধিক আইনজীবী বলেন, প্রতি পাতায় কোর্ট ফি ১০ টাকা, ফোলিও ২ টাকাসহ মোট খরচ ১২ টাকার মতো। নকল শাখাগুলোতে স্টেনো টাইপিস্ট নেই। টাইপ করাতে হয় বাইরে থেকে। এ অজুহাতে এক পাতার খরচ মামলা বিশেষে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। আদালত ভেদে এ খরচে ভিন্নতা রয়েছে।’

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট আজাদ রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিচারপ্রার্থী অনেকের আদালত নিয়ে অস্বস্তি থাকে। অনেকে ঘুষ দিয়ে হলেও অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেতে চান। এ সুযোগটাই নিচ্ছে একশ্রেণির মানুষ। এ বিষয়ে কোনো নজরদারি বা কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির খুব বেশি নেই।’ ঢাকা আইনজীবী সমিতির অ্যাডহক সভাপতি অ্যাডভোকেট খোরশেদ মিয়া আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আদালতপাড়ায় এ ধরনের অভিযোগ প্রতিনিয়ত শোনা যায়। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেও রোধ করতে পারছি না। তবে আমরা আইনজীবীদের এসব কাজে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করি।’