
সংবিধান সংস্কার , জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ( পিআর ) নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব কমছেই না । প্রধান এই তিন ইস্যুতে বিএনপির বিপরীত অবস্থান বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির ( এনসিপি ) । কোনো পক্ষই ছাড় দিতে রাজি নয় । দলগুলোর এই অনড় অবস্থানে অনৈক্যের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন । রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন , সভা , সমাবেশ , আলোচনায় এই তিন ইস্যুতে দূরত্ব - অনৈক্য বোঝা গেলেও ভেতরে - ভেতরে রয়েছে অন্য হিসাব নিকাশ ।
জামায়াত ও এনসিপির একাংশ মনে করছে , আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে বিএনপি পুরো ফায়দা পাবে । বর্তমানে প্রশাসনসহ বড় সব জায়গায় জামায়াত ও এনসিপির মতাদর্শীরা আছেন । কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় এলে সবকিছু বদলে দেবে । এই আশঙ্কা থেকে দল দুটি সংস্কার , জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও পিআর পদ্ধতি নিশ্চিত করতে চাইছে । এতে নির্বাচন বিলম্বিত হলেও সমস্যা নেই । কিন্তু মাঠের পরিস্থিতি বুঝে বিএনপি যেকোনোভাবে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চায় । বিলম্বের আশঙ্কাকে তারা ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে । এই তিন দলের এমন অবস্থানে মাঠে নামতে পারে জাতীয় পার্টির ( জাপা ) দুই অংশ ।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও নির্বাচন কমিশনের ( ইসি ) ঘোষণা অনুযায়ী , আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে । ইসি আজ বৃহস্পতিবার এই নির্বাচনের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণা করবে । নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতিও সারছে । সব মিলিয়ে নির্বাচনের একটি আবহ তৈরির অবস্থা । কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব - অনৈক্য সব সম্ভাবনাকে অনিশ্চয়তার পথে নিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা । রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য দূর করার চেষ্টা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও । তারা দফায় দফায় সংলাপ করেছেন দলগুলোর সঙ্গে । দূরত্ব কমিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় আবারও সংলাপে বসবে । রাজনৈতিক দলগুলোকে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে এক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আলী রীয়াজ ।
তিনি বলেন , ‘ পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন । আন্দোলন - সংগ্রামে একত্রে থেকেছেন , এটা অব্যাহত রাখুন । ' তিনি আরও বলেন , “ এখন আমরা একটা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থায় আছি । সেটা শুধু সরকার হিসেবে না , সবাই । বাংলাদেশে রাজনীতির একটি অন্তর্বর্তী পরিস্থিতিতে ঐক্য , পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ , সহনশীলতার জায়গাটা ধরে রাখা দরকার । কেননা পরাজিত শক্তিরা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে , সেটা যেন না নিতে পারে , সে জন্য রাজনীতিবিদদের সজাগ ও সক্রিয় থাকতে হবে । ’ জামায়াতের দ্বিধা , সংশয় : জামায়াতে ইসলামী স্পষ্টই বলেছে , জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং পিআর পদ্ধতির সিদ্ধান্ত না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না । দলটি ‘ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ' তৈরির দাবিও জানাচ্ছে । এগুলোসহ সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে দলটি মিছিল , সমাবেশও করছে । রাজপথে এসব কর্মসূচির মাধ্যমে তারা নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে । পাশাপাশি সরকার , বিএনপিসহ সংশ্লিষ্টদের বার্তা দিচ্ছে । রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন , গত বছরের ৫ আগস্ট গণ - অভ্যুত্থান - পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে জামায়াত । প্রশাসন , বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জামায়াত - সমর্থিত ব্যক্তিরা ভালো অবস্থায় রয়েছেন । ১৬ টির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সমর্থিত ব্যক্তি উপাচার্য হয়েছেন । প্রশাসনের উচ্চপর্যায়েও একই অবস্থা । দলটির আশঙ্কা , ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে বিএনপি বেশি আসন পাবে । বিএনপি ক্ষমতায় এলে তাদের এই শক্তি ’ ভেঙে দেবে । অভ্যুত্থানের সব অর্জন নষ্ট করে দেবে । এ কারণে দলটি বুঝে - শুনে নির্বাচনে যেতে চায় ।
অবশ্য জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের আজকের পত্রিকাকে বলেন , ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে জামায়াতের আপত্তি নেই । তবে নির্বাচনের বড় প্রস্তুতিমূলক কাজ সংস্কার । সেটিকে চূড়ান্ত করতে হবে , সংস্কারের আইনি ভিত্তি দিতে হবে । তিনি বলেন , প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি ছিল সংস্কার , বিচার ও নির্বাচন করার । নির্বাচনের ঘোষণা তিনি দিয়েছেন , তার আগে তো সংস্কার হতে হবে । সেটি এখনো সম্পূর্ণ হয়নি । এনসিপি সংস্কারের পক্ষে অনড় সূত্র বলছে , জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের গড়া দল এনসিপি সংস্কারের পক্ষে অনড় অবস্থানে রয়েছে । প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয় মাসে দলটি খুব গুছিয়েও উঠতে পারেনি । দলটির বেশির ভাগ নেতাই গণপরিষদ নির্বাচন ছাড়া সংসদ নির্বাচন চান না । তাঁরা পিআর পদ্ধতি ও নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের আইন ভিত্তি দেওয়ার পক্ষে । এসব দাবি পূরণ হলে তাঁরা নির্বাচনে যাওয়ার কথা বলছেন । সব শর্ত পূরণ না হলে নির্বাচনের পর পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা । রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এনসিপি এখনো গোছাতে পারেনি । ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এনসিপির মধ্যে একাধিক ধারা রয়েছে । বিভিন্ন দল থেকে আসা নেতাদের একটি অংশ নির্বাচনের পক্ষে । তাঁরা রাজনীতিতে অবস্থান তৈরি করতে নির্বাচনে যেতে চান । তবে দলের বেশির ভাগ নেতাই প্রথমে জাতীয় নির্বাচনের বিপক্ষে । এ
নসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গণপরিষদ নির্বাচন ও নতুন সংবিধান না হলে আমরা নির্বাচনে যাব না । আমাদের দাবি জনগণের দাবি । সেটা নিয়েই জনগণের কাছে যাব । নতুন সংবিধান , সংস্কার ও বিচারের দাবির সঙ্গে মানুষকে সম্পৃক্ত করে একটি বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে আমরা এগিয়ে যাব । '
তিনি বলেন , পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসরদের নিয়ে যদি কোনো পক্ষ কিংবা সরকারও কোনো চিন্তাভাবনা করে , জনগণ তা রুখে দেবে । জি এম কাদের ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির দুই অংশের কার্যক্রমকেই সন্দেহের চোখে দেখছে জামায়াত ও এনসিপি । দল দুটি মনে করছে , সংস্কার , জুলাই সনদ ও পিআর পদ্ধতি নিয়ে তাদের অনড় অবস্থানের সুযোগ নিয়ে একটি পক্ষ নিজেদের পাল্লা ভারী করতে জাপার দুই অংশকে মাঠে নামাতে পারে । জাপা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নির্বাচনেও নামতে পারে । কারণ , অতীতে দলটি বিএনপি , জামায়াতসহ অধিকাংশ দলের বর্জন করা নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের আমলের নির্বাচনকে সাংবিধানিক বৈধতা দিয়েছিল ।
জামায়াত ও এনসিপির নেতাদের আশঙ্কা , নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেও তিন ইস্যুতে তাঁরা অনড় থাকলে জাপা আবার তুরুপের তাস হতে পারে । যাতে এবার লাভবান হবে বিএনপি । এ জন্য তাদের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে পর্দার অন্তরালে জাপাকে একটি পক্ষ বানানোর আয়োজন চলছে বলে তাঁরা সন্দেহ ও আশঙ্কা করছেন । বিএনপির সামনে চাপ : দীর্ঘ দেড় দশকের ক্ষমতার খরা কাটাতে চায় বিএনপি । দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্ৰ পর্যন্ত এ ব্যাপারে চাপ রয়েছে । পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে যে সুযোগ তৈরি হয়েছে , তা কোনোভাবেই হারাতে চায় না বিএনপি ; যে কারণে সাবধানে পা ফেলে অগ্রসর হচ্ছে দলটি । বিএনপি মনে করে , তাদের চাপে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা এসেছে । আজ ওই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে যাচ্ছে ইসি । কিন্তু এরপরও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না বিএনপিতে । এর কারণ আরেক পক্ষের অনড় অবস্থান । বিএনপি স্পষ্টই বলছে , তারা পিআর পদ্ধতিতে নেই । উচ্চকক্ষের বিরোধিতা করছে , জুলাই সনদ – বাস্তবায়নে গণভোটের প্রস্তাবকে সংবিধানবহির্ভূত বলছে । এসব ক্ষেত্রে জামায়াত - এনসিপির অবস্থান বিএনপিকে কঠিন সমীকরণে নিয়ে যাচ্ছে । ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে বিএনপির অনিশ্চয়তার কথা এসেছে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যেও ।
গতকাল বুধবার এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন , “ আজকে কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক মহল অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য , নির্বাচনকে ব্যাহত করার জন্য নিত্যনতুন দাবি তুলে চলেছে । এগুলো নিয়ে তারা হুমকি দিচ্ছে , কথা বলছেন , অত্যন্ত জোরেশোরে হুমকি দিচ্ছেন । আমার প্রশ্নটা হচ্ছে , কেন করছেন এটা ? ” তিনি বলেন , ‘ সরকারের ভেতরে একটা মহল , তারা অত্যন্ত সচেতনভাবে চেষ্টা করছে , যারা গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি , তারা যেন আসতে না পারে । ” মির্জা ফখরুল বলেন , এখনো সময় আছে । জুলাই সনদ , সংস্কার এসব নিয়ে জটিলতা না বাড়িয়ে সরকার যেন কার্যকর ব্যবস্থা নেয় ; যাতে দলগুলো নির্বাচনমুখী হয় । রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন , নির্বাচনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হলে বিএনপিকেই এগিয়ে এসে অন্য দলগুলোকে ভরসা দিতে হবে , আস্থায় আনতে হবে ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন , বিএনপির উচিত আন্তরিকতার সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের উদ্বেগ চিহ্নিত করা এবং তাদের আশ্বস্ত করা যে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলে তারা কোনো অবিচার করবে না কিংবা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করবে না । দলগুলোকে আস্থা ও নিশ্চয়তা দেওয়া গেলে অন্যরা বিএনপিকে বিশ্বাস করতে পারবে । তবে তিনি বলেন , কিছু দল যদি ভিন্ন উদ্দেশ্যে নির্বাচন ঠেকাতে চায় , সে ক্ষেত্রে বিএনপির পক্ষে সমন্বয় করা সম্ভব নয় । সেটা কারও পক্ষেই সম্ভব নয় । নির্বাচনের চেষ্টায় সরকার : দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে । এ জন্য প্রকাশ্য ও অন্তরালে বৈঠক চলছে । আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয় করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে । কিন্তু দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার বদলে এখন শর্ত মুখ্য হয়ে উঠেছে ।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ( জাতীয় ঐকমত্য ) মনির হায়দার আজকের পত্রিকাকে বলেন , রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানকে কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য কমিশনের বিভিন্ন রকম চেষ্টা ও তৎপরতা চলমান আছে । পর্যবেক্ষকেরা বলছেন , নির্বাচন না হলে শুধু বিএনপি নয় , জামায়াত ও এনসিপিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে । রাজনৈতিক অচলাবস্থা দীর্ঘ হলে জনগণের মধ্যে হতাশা জন্মাবে । দলগুলো পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মাধ্যমে দলীয় অবস্থান তুলে ধরছে বলে মনে করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের ( সুজন ) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার । তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন , “ গণতান্ত্রিক উত্তরণের লক্ষ্যে সবাই একমত হয়ে প্রস্তাবিত জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করবে ; যার মাধ্যমে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম হবে এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ প্রশস্ত হবে । ”