
ছয় বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর। এরই মধ্যে প্রার্থিতা ও ভোটার তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে। শুরু হয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার-প্রচারণাও। ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব আন্দোলনে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে ডাকসু এবং এর নেতৃবৃন্দ। এ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন ও ঢাবি প্রশাসনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাষ্ট্রীয় সংস্থার সঙ্গে একাধিক ফলোআপ সভা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের ‘দ্বিতীয় সংসদ’ হিসেবে খ্যাত এই ডাকসু নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে প্রশাসনের চেষ্টার কমতি নেই। অন্তর্বর্তী সরকার ও ঢাবি প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই নির্বাচনের পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে আগামীর বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির রূপ কেমন হবে। ফলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনটি প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও মতের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। এমন প্রেক্ষাপটে ডাকসু নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং ক্যাম্পাসের বাইরের শক্তির প্রভাবমুক্ত রেখে আয়োজন করা গেলে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইতিবাচক পরিবেশ থাকার পূর্বাভাস দেবে। তাই এই নির্বাচনকে ‘অ্যাসিড টেস্ট’ হিসেবে দেখছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ডাকসু নির্বাচন যত সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে আয়োজন হবে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেটির প্রতিফলন অবশ্যই ঘটবে। আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও তার প্রভাব পড়বে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। তা ছাড়া নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণাও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছাপ লক্ষ করা যাচ্ছে।
জানা যায়, দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ডাকসু ছিল ভ্যানগার্ডের ভূমিকায়। ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিবেচনায় ডাকসু নির্বাচন বহুমুখী গুরুত্ব বহন করে। এরই মধ্যে এই নির্বাচনকে ঘিরে চাঞ্চল্য শুরু হয়েছে ক্যাম্পাসে। যার আঁচ সারা দেশেও লাগতে শুরু করছে। এবারের নির্বাচনের বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের ডাকসুর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তারা অংশ নিতে পারছে না।
ডাকসু নির্বাচনের আগের দিন (৮ সেপ্টেম্বর) ও নির্বাচনের দিন (৯ সেপ্টেম্বর) মেট্রোরেলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন বন্ধ থাকবে। যেসব শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের বাইরে থাকেন, তাদের ভোটদানের জন্য বিভিন্ন রুটে বাসের অতিরিক্ত ট্রিপের ব্যবস্থা করা হবে। এসব বাস নির্বিঘ্নে চলাচল নিশ্চিত করতে পুলিশের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হবে।
তথ্যমতে, ১০৪ বছর বয়সী দেশের সবচেয়ে পুরোনো উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ তথা ডাকসু নির্বাচন হয়েছে ৩৭ বার। এর মধ্যে ২৯ বার অনুষ্ঠিত হয়েছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে। আবার স্বাধীনতার ৫৩ বছরে হয়েছে ৮ বার। অথচ ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রতিবছর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ডাকসুর মনোনীত পাঁচজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধির বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম ‘সিনেট’-এর সদস্য হয়ে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ ও সমস্যা তুলে ধরার কথা। তবে নিয়মিত এই নির্বাচন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে থাকছে না শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব।
ডাকসুর সর্বশেষ কমিটির মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের মার্চে। এরপর তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আশ্বাসেই পাঁচ বছর পার হয় ডাকসু নির্বাচন আয়োজনের। কিন্তু বর্তমানে সে পরিস্থিতি একেবারেই বদলে গেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর এই নির্বাচন আয়োজন নিয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়।
‘‘এ মুহূর্তে আমাদের শিক্ষার্থীদের কোনো দ্বন্দ্ব-বিবাদে জড়ানো যাবে না। পরস্পরের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা আমাদের অস্তিত্বের জন্যই দরকার হবে। যারা এই নির্বাচনে প্রার্থী ও ভোটার সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের অংশ। কেউ অগ্রজ, কেউ অনুজ এবং কেউ সতীর্থ—অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান, ভিসি
এ নিয়ে ক্যাম্পাসে নানা কর্মসূচিও পালন করা হয়েছে। ভিসি অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনও এই নির্বাচন আয়োজন নিয়ে ইতিবাচক। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের মাথায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসন্ন ডাকসু নির্বাচন আয়োজনকে নিচ্ছে।
ডাকসু নির্বাচনের সাত দিন আগে থেকে আবাসিক হলে কোনো বহিরাগত থাকতে পারবেন না। নিয়মিত টহল পরিচালনার মাধ্যমে এ ব্যবস্থা কার্যকর করা হবে। তবে ছাত্রীদের হলগুলোতে কখনোই বহিরাগতরা থাকতে পারেন না।
ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে ক্যাম্পাসে কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ডাকসুর নির্বাচন কমিশন ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিয়মিত ফলোআপ বৈঠক করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ২০০ সিসিটভি ক্যামেরা মনিটর করছে পুরো ক্যাম্পাস। পাশাপাশি ক্যাম্পাসের প্রবেশমুখ ও ভেতরে পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে।
ভোট গ্রহণের দিন ভোটকেন্দ্রে তিন স্তরের নিরাপত্তা থাকবে। প্রথম স্তরে থাকবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসি সদস্য ও প্রক্টরিয়াল টিম। দ্বিতীয় স্তরে পুলিশ বাহিনী মোতায়েন থাকবে। তৃতীয় স্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি প্রবেশমুখে সেনাবাহিনী ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসেবে অবস্থান করবে। বুথ ছাড়া পুরো ভোটকেন্দ্র সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় থাকবে। ভোট গণনাও সিসিটিভি ক্যামেরার সামনে সম্পন্ন হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে (ডাকসু) বলা হয় দেশের দ্বিতীয় সংসদ। ডাকসু নির্বাচনের প্রতি তাই দেশবাসীর আগ্রহ বেশ। এবার ডাকসুতে ২৮ পদে প্রার্থী ৪৭০ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে ছাত্রী ৬২ জন। ভোট গ্রহণ করা হবে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর।
তথ্যমতে, কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে ডজনখানেক বৈঠক করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেখানে ডাকসুর নির্বাচন কমিশন ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এসব বৈঠকে অংশ নেওয়া সরকারি একটি সংস্থার একজন প্রতিনিধি বলেন, ডাকসু নির্বাচন রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট হিসেবে ধরে নিয়েছে বর্তমান সরকার। তাই প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যাতে এই নির্বাচনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে, তার প্রতিফলন হবে এই ডাকসু নির্বাচন। তাই এই নির্বাচন কীভাবে পরিচালনা করা হবে এবং শিক্ষার্থীরা কীভাবে নিচ্ছে, সেটাই এখন বড় ইস্যু হয়ে গেছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে। ফলে তারা যে ভূমিকা পালন করবে, সেটাই আগামীর বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির রূপ হবে দাঁড়াবে।
ডাকসুর ভোট গ্রহণের দিন প্রয়োজন অনুযায়ী সেনাবাহিনী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করবে এবং ভোট শেষে ফলাফল প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র সেনাসদস্যরা কর্ডন করে রাখবেন। ভোট গণনার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও প্রবেশের সুযোগ থাকবে না।
এসব বৈঠকে অংশ নেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কোনো আয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটা দেশের পরবর্তী জাতীয় রাজনীতি গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবে। তাই আমরা শিক্ষার্থীদের নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারি সে বিষয়ে বারবার বুঝানোর চেষ্টা করছি। কেননা তাদের হাত ধরে ’৫২, ’৭১, ’২৪-এর মতো জাতির বড় বড় উপহার ঘরে তোলা হয়েছে। তাই তারা ডাকসুতে যে ভূমিকা রাখবে, সেটাই আগামীতে পুরো দেশ গ্রহণ করবে। এ কারণে ডাকসু নির্বাচন প্রশাসনের জন্য একপ্রকার অ্যাসিড টেস্ট।’
ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সহনশীল হতে অনুরোধ করেছেন ভিসি অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান। নতুবা এ নির্বাচনে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
ডাকসুর ভোট গ্রহণের দিন ৮টি ভোটকেন্দ্রে তিন স্তরের নিরাপত্তা থাকবে। প্রথম স্তরে থাকবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসি সদস্য ও প্রক্টরিয়াল টিম। দ্বিতীয় স্তরে পুলিশ বাহিনী মোতায়েন থাকবে। তৃতীয় স্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি প্রবেশমুখে সেনাবাহিনী ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসেবে অবস্থান করবে।
অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ‘প্রার্থীর তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে এবং প্রচার-প্রচারণাও শুরু হয়েছে। তাই এ মুহূর্তে আমাদের শিক্ষার্থীদের কোনো দ্বন্দ্ব-বিবাদে জড়ানো যাবে না। পরস্পরের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা আমাদের অস্তিত্বের জন্যই দরকার হবে। যারা এই নির্বাচনে প্রার্থী এবং ভোটার সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের অংশ। কেউ অগ্রজ, কেউ অনুজ এবং কেউ সতীর্থ।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে এমন কোনো বড় ধরনের দ্বন্দ্ব-বিবাদ হওয়ার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই, যদি না কোনো বড় দুরভিসন্ধি না থাকে। এ সময়ে যদি আমরা সহনশীল না হলে তৃতীয় পক্ষ তার সুযোগ নেবে। ঘোলাপানিতে মাছ শিকারে যারা আগ্রহী তারাও তোমার এবং আমার এ দুর্বলতার সুযোগ নেবে। ডাকসু নির্বাচন একটি জটিল প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ আছে।’