Image description

পাবনার ঈশ্বরদীতে নির্মাণাধীন রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও স্পর্শকাতর প্রকল্প। গুরুত্ব বিবেচনায় এখানে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও মেধাবী জনবল নিয়োগ হওয়ার কথা থাকলেও ঘটেছে উল্টোটা। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ও ভারতের আশীর্বাদপুষ্ট এবং মোটা অঙ্কের ঘুসের বিনিময়ে বসানো হয়েছে দেশবিরোধী, অসৎ ও অদক্ষদের।

 

এমনকি জাল সনদে স্থায়ী করা হয়েছে চাকরি। প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য গঠিত নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডে (এনপিসিবিএল) জনবল নিয়োগে এমন বেপরোয়া অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রতারণা ও স্বজনপ্রীতির নজিরবিহীন অভিযোগ পাওয়া গেছে।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত একাধিক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এক হাজার ৮০০ জনের বেশি জনবল নেয় এনপিসিবিএল কর্তৃপক্ষ। তাদের মধ্যে প্রায় এক হাজার ৪০০ জনকে রাশিয়ার রোসাটম টেকনিক্যাল একাডেমিতে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। তবে ২০১৯ ও ২০২৩ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়া ঘিরে জাল সনদ, ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ, ঘুস এবং স্বজনপ্রীতির বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে।

২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ব্যবস্থাপক (গ্রেড-৫) পদের জন্য শর্ত ছিল বিদ্যুৎকেন্দ্র বা পারমাণবিক স্থাপনায় ৯ বছরের অভিজ্ঞতা এবং তার মধ্যে উপব্যবস্থাপক (গ্রেড-৬) পদে অন্তত দুই বছরের অভিজ্ঞতা। উপব্যবস্থাপক ও ঊর্ধ্বতন সহকারী ব্যবস্থাপক পদেও ছিল অভিজ্ঞতার শর্ত। কিন্তু বিভিন্ন নথি যাচাইয়ে দেখা গেছে, নিয়োগ পাওয়া অনেকেরই ন্যূনতম এ যোগ্যতা ছিল না।

ভুয়া সনদে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম আল মামুন। তিনি ডেপুটি চিফ সুপারিনটেনডেন্ট (টেকনিক্যাল সাপোর্ট) হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি অভিজ্ঞতার শুরু দেখিয়েছেন ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে অথচ তার বিএসসি শেষ হয় ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে। অর্থাৎ শিক্ষাজীবনের সঙ্গেই অভিজ্ঞতা দাবি করেছেন এ কর্মকর্তা। যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তিনি মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে চাকরি স্থায়ী করান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী প্রায় এক বছরের অভিজ্ঞতার ঘাটতি ছিল একেএম নাজমুল হাসানের। এরপরও তিনি কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে নিয়োগ পান। বর্তমানে প্ল্যান্ট অপারেশন বিভাগের ডেপুটি চিফ সুপারিনটেনডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

২০২৩ সালে প্রকাশ করা এক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ডেপুটি হেড অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্ট পদের জন্য শর্ত ছিল সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ বা অন্য কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে অন্তত সাত বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা। কিন্তু আবু কায়সারের কোনো সামরিক বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে চাকরির অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তিনি এ পদে নিয়োগ পান।

২০১৯ সালে গ্রেড-৭-এর একটি পদে নিয়োগ পান রবিউল আলম। তিনি খুলনা পাওয়ার কোম্পানিতে তিন বছরের অভিজ্ঞতা দেখান। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই সময় তিনি ছিলেন ঠাকুরগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইন্সট্রাক্টর। অর্থাৎ দুই জেলায় একই সময়ে দুই চাকরি করেছেন, যা স্পষ্ট জালিয়াতি। এরপরও ২০২৪ সালে তাকে গ্রেড-৬ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম-দুর্নীতির আরেক আলোচিত নাম মুশফিকা আহমেদ। রূপপুর প্রকল্পের চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ছিলেন ডেল্টা হাসপাতালের মেডিকেল ফিজিস্ট। বিদ্যুৎকেন্দ্র বা পরমাণু স্থাপনায় কাজের কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তাকে ব্যবস্থাপক (কেমিক্যাল অ্যান্ড রেডিওঅ্যাক্টিভ ওয়েস্ট) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

বর্তমানে তিনি কেমিক্যাল টেকনোলজিস অ্যান্ড রেডিওঅ্যাক্টিভ ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ডেপুটি চিফ সুপারিনটেনডেন্ট এবং সম্প্রতি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ চিফ সুপারিনটেনডেন্টের অতিরিক্ত দায়িত্ব পেয়েছেন। এ নিয়েও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লিখিতভাবে আপত্তি জানিয়েছে।

অভিযোগ আছে, মুশফিকা আহমেদের বড় বোনের স্বামী মইনুল ইসলাম তিতাস বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পারমাণবিক শক্তি উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব। তিনি রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০১৯ সালের বোর্ডের সদস্য ছিলেন।

মুশফিকাকে সুবিধা দেওয়ার জন্য মইনুলের হস্তক্ষেপে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পড়াশোনার বিষয় চাওয়া হয় ফিজিক্স ও ক্যামিস্ট্রি। এখানে ফিজিক্সের কোনো বিষয় না থাকলেও শুধু তাকে চাকরি দেওয়ার জন্য এটি যুক্ত করা হয়। এমনকি মুশফিকার স্বামী সোহেল রেজাকেও সংশ্লিষ্ট কাজে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ দেন এই অতিরিক্ত সচিব।

শুধু তাই নয়, পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে ২০১৯ সালের বিজ্ঞপ্তিতে সিজিপিএর কোনো সর্বনিম্ন মানদণ্ড রাখা হয়নি। অথচ ২০২১ সালে স্পষ্টভাবে ৪ দশমিক ০০ স্কেলে অন্তত ৩ দশমিক ০০ সিজিপিএ চাওয়া হয়। নিজেদের মনোনীত প্রার্থীকে সুবিধা দিতে ২০১৯ সালের নীতিমালা ইচ্ছাকৃতভাবে শিথিল করা হয়েছিল।

ওই সময় মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান ছিলেন ড. কবির হোসেন। বর্তমানে তিনি প্রকল্প পরিচালকের পদে আছেন। নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে কর্মকর্তারা প্রশ্ন তুললে জুলাই বিপ্লবের পর তিনি সংশ্লিষ্টদের একটি ই-মেলই পাঠান। তাতে লেখা ছিল, ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তার কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল না। নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করেছেন কোম্পানির সচিব এস আবদুর রশিদ এফসিএস, অর্থ ও প্রশাসন প্রধান অলোক চক্রবর্তী এবং তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. শৌকত আকবর।

অভিযোগ আছে, অলোক চক্রবর্তী রূপপুর প্রকল্পে ‘ভারতের চর’ হিসেবে বেশ সক্রিয়। তিনি নিয়োগও পেয়েছিলেন ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনের সুপারিশে। তিনি নিয়মিত প্রতিবেশী দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গেও দেখা করেন এবং তথ্য পাচার করেন।

যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রকল্পে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের অভিযোগ, নিয়োগে অনিয়ম ও জালিয়াতির বিষয়ে এনপিসিবিএলের অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. জাহেদুল হাসানকে একাধিকবার অবহিত করা হলেও তিনি ব্যবস্থা নেননি। বরং অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে দমননীতি গ্রহণ করেন। এরই অংশ হিসেবে চিফ সুপারিনটেনডেন্ট হাসমত আলীসহ ১৮ প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাকে কোনো কারণ ছাড়াই চাকরিচ্যুত এবং ১১ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

ড. জাহেদুল তখন ছিলেন ডেপুটি প্রজেক্ট ডিরেক্টর (ডিপিডি-১)। একই সঙ্গে তিনি ভাইভা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। তিনি মূলত প্রকল্পের কেনাকাটার বিষয়গুলো দেখতেন। তার পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী মন্ত্রীর আশীর্বাদে প্রকল্প পরিচালক বা পিডি হন। এই পদ দখল এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার পথ মসৃণ করার জন্য তিনি অবৈধ নিয়োগগুলোর নেপথ্যে ছিলেন। হাতিয়েছেন বিপুল পরিমাণ টাকা। পরে তিনি বিতর্কিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদন্নতি দেন এবং অতিগুরুত্বপূর্ণ পদে বসান। স্থায়ী করেন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া সব কর্মকর্তার চাকরি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র শুধু বিদ্যুৎ প্রকল্প নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গেও সরাসরি যুক্ত। সেখানে নিয়োগে অনিয়ম মানে পারমাণবিক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়া। পর্যবেক্ষকদের মতে, নিয়োগে অনিয়মের তদন্ত হওয়া জরুরি এবং যারা যোগ্যতা ছাড়াই জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি পেয়েছেন, তাদের অপসারণ ছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

রোসাটমের উদ্বেগ

ড. জাহেদুলের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার থাকা এবং প্রকল্পটি ইচ্ছামতো চালানোর জন্য সম্প্রতি তিনি চিফ সুপারিনটেনডেন্ট প্রকৌশলী হাসমত আলীকে বিনা কারণে অব্যাহতি দেন। যাকে তার স্থলাভিষিক্ত করেছেন, তার বিষয়ে ঘোর আপত্তি আছে প্রকল্পের রাশিয়ান ঠিকাদারি কোম্পানি রোসাটমের। প্রতিষ্ঠানটি গত ২৭ মে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন বরাবর একটি চিঠিতে এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগের কথা জানায়।

চিঠিতে বলা হয়, উচ্চ কারিগরি ও স্পর্শকাতর এ প্রকল্পের পরিচালকের পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ হলো চিফ সুপারিনটেনডেন্ট, যিনি পুরো প্রকল্পের কারিগরি বিষয়ের প্রধান। সম্প্রতি ওই পদে মুশফিকা আহমেদকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যিনি পদার্থবিজ্ঞান থেকে পাস করা । প্রকৌশল কাজে তার ন্যূনতম যোগ্যতা ও দক্ষতা কোনোটিই নেই। এছাড়া তার চাকরির নিয়োগের বৈধতা নিয়েও আছে প্রশ্ন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত অনুযায়ী পরমাণু ও বিদ্যুৎকেন্দ্র সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা চাওয়া হলেও মুশফিকা চাকরি করেছেন ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব কমিশনিং, অপারেশন, সেফটি ও প্রযুক্তিগত দিকনির্দেশনার দায়িত্ব থাকা এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রকৌশল জ্ঞান না থাকা ব্যক্তিকে বসানোয় বিস্মিত হয়েছে রোসাটম।

নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ড. কবির হোসেন, এনপিসিবিএলের সাবেক এমডি ড. শৌকত আকবর, এনপিসিবিএলের অন্তর্বর্তীকালীন এমডি ড. জাহেদুল এবং কোম্পানি সচিব এস আবদুর রশিদ ও অতিরিক্ত সচিব মইনুল ইসলাম তিতাসের মোবাইল ফোনে একাধিক দিন দফায় দফায় কল দিলেও তারা রিসিভ করেননি। এমনকি আমার দেশ-এর পরিচয় দিয়ে তাদের হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠালেও তারা জবাব দেননি।