Image description
ভারতের দখল থেকে কোদলা নদীর ৫ কিলোমিটার উদ্ধার করল বিজিবি

জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বেশ সতর্ক দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। একটুতেই দুই পক্ষে লেগে যাচ্ছে ঠোকাঠুকি। এতে সীমান্তে বাড়ছে উত্তেজনা।

দুই দেশের সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মান্নান আজকের পত্রিকাকে বলেন, গত ১৫ বছরে ভারতীয় বিএসএফ আগ্রাসী আচরণ করেছে। পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যেও বিএসএফ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে। তিনি আরও বলেন, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত যে আচরণ দেখাচ্ছে, বাংলাদেশ সরকারও পাল্টা জবাব দিচ্ছে। উত্তেজনা কমাতে সীমান্তে কমান্ডার পর্যায়ে আলোচনার দরকার আছে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার তিন দিন পর ৮ আগস্ট ক্ষমতা গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। ১৩ আগস্ট এই সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, ‘দেশের সীমান্তে ঢুকে মানুষ মারলেও পতাকা বৈঠক করে বলা হতো, সব ঠিক হয়ে গেছে। সেই দিন শেষ হয়ে গেছে। বিজিবির মতো একটা ফোর্সকে (বাহিনী) পিঠ দেখাতে বলেছে সীমান্তে। সীমান্তে আমাদের লোক মারে, বিজিবি পতাকা বৈঠক করতে বাধ্য হয়। আমি বলেছি, পিঠ দেখাবেন না। এনাফ ইজ এনাফ (যথেষ্ট হয়েছে)।’

অন্তর্বর্তী সরকারের গত পাঁচ মাসে সীমান্ত হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নজরদারি বাড়িয়েছে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। সীমান্তে বিভিন্ন ঘটনায় পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছে দুদেশের সরকার।

এতে দুই দেশের সীমান্ত নিয়ে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় উত্তেজনা বেড়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরই ভারত সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন, নজরদারির জন্য বৈদ্যুতিক যন্ত্র ও অত্যাধুনিক ক্যামেরা লাগাচ্ছে। যেখানে নদী বা অন্য কোনো কারণে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সুযোগ নেই, সেখানে নজরদারির জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরাসহ বিশেষ যন্ত্র স্থাপন করা হচ্ছে।

জানা গেছে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটারের মধ্যে ভারত ৩ হাজার ২৭১ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে। তারা বাকি ৮৮৫ কিলোমিটারজুড়ে বিভিন্ন অংশে স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাটের তিনবিঘা করিডর, নওগাঁর পত্নীতলা, ফেনী, কুষ্টিয়া ও কুমিল্লায় ভারত কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকাজ শুরু করে। বিভিন্ন সীমান্তে বাংলাদেশি কৃষকদের চাষ ও সেচকাজে বাধা দিচ্ছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।

৭ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চৌকা সীমান্তের ওপারে ভারতের সুখদেবপুর সীমান্তে বিএসএফের কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এতে সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে গ্রামবাসীদেরও জড়ো হওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

জানা যায়, সেখানে সীমান্তে কোনো কাঁটাতারের বেড়া ছিল না এবং সেই বেড়া তৈরির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরে ১০০ গজ ভেতরে মাটি খোঁড়া হচ্ছিল। এ কারণে বাংলাদেশের তীব্র আপত্তির মুখে ভারতীয়রা কাজটি বন্ধ করে দেয়।

এ বিষয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) উপমহাপরিচালক (যোগাযোগ) কর্নেল মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করতে চেয়েছে। আমরা জোর আপত্তি জানানোর ফলে তারা সেটা বন্ধ করেছে। স্থানীয় জনগণও এতে যোগ দিয়েছেন।’

এদিকে সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ায়, এমন উসকানিমূলক পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার জন্য ভারতকে পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ। গত রোববার ঢাকায় দেশটির হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে এ পরামর্শ দেন পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন। সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সাম্প্রতিক কার্যকলাপ নিয়ে পররাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশ সরকারের গভীর উদ্বেগের কথা জানান হাইকমিশনারকে।

ওই দিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের জিরো লাইন থেকে দেড় শ গজের মধ্যে ভারতকে কোনো কাজ করতে দেওয়া হবে না। এর মধ্যে ৩টি জেলার পাঁচটি সীমান্তে বিএসএফকে কাজ বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে। ২০১০-২৩ সাল পর্যন্ত ভারত সীমান্তে কিছু অসম কাজ করা হয়েছে, যেগুলো ভারতের করা উচিত হয়নি। কিন্তু আগের সরকার সে সুযোগ ভারতকে দিয়েছে।

এই অবস্থায় আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি বিজিবি-বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠক হবে বলে জানা গেছে। বৈঠকে সীমান্তে হত্যা, কাঁটাতারের বেড়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, ‘আলোচনা করব, যাতে কাজগুলো বন্ধ করা যায়। সীমান্তে প্রচুর শক্তি আছে। জনগণ হলো বড় শক্তি।’

বিজিবি সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ সীমান্তে ২৪ জন বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে ভারত। আগের বছর ২০২৩ সালে নিহত হয়েছিলেন ২৯ জন। ২০২৪ সালে নিহত ২৪ জনের মধ্যে বিএসএফের হাতে ১৯ আর ভারতীয় নাগরিকদের হাতে ৫ জন বাংলাদেশি নিহত হন। এর মধ্যে ৫ আগস্টের আগে ১৯ জনকে এবং তারপর আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গত পাঁচ মাসে ৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে।

সীমান্তে হত্যা নিয়ে বিজিবির উপমহাপরিচালক (যোগাযোগ) কর্নেল মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, সীমান্তে নজরদারি ও টহল বাড়ানো হয়েছে। চোরাচালান ও অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার রোধে টহলের পাশাপাশি সীমান্ত এলাকার জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এতে সীমান্তে হত্যাও কিছুটা কমেছে।