
জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তথ্যভান্ডারের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটির ১৯ কর্মকর্তার পাসপোর্ট জব্দ এবং তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে পাসপোর্ট এবং ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যক্তির বিষয়ে অধিকতর তদন্তেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। নির্বাচন কমিশন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এর আগে টাইগার আইটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশন। সম্প্রতি পাঠানো ওই চিঠিতে টাইগার আইটির সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন ১৯ ব্যক্তির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি এবং পাসপোর্ট জব্দ রাখার অনুরোধ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইডিয়া-২ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ আজিজুর রহমান সিদ্দিকী কথা বলতে রাজি হননি। নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল সানাউল্লাহ ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে ইসির একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে চিঠি পাঠানোর কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, এ চিঠিতে দেড় ডজনের বেশি ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির কথা বলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, যেসব ব্যক্তির পাসপোর্ট জব্দ করার কথা বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন—টাইগার আইটির মালিক জিয়াউর রহমান, তার ছেলে নামির রহমান, পরিচালক রাশেদ সরোয়ার, পরিচালক তপনেন্দ্র নাথ ও সটফওয়্যার উন্নয়ন কর্মকর্তা জিয়া উল হক প্রমুখ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র এক কর্মকর্তা ইসির চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি আমার দেশকে বলেন, চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। পাসপোর্ট এবং ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাদের পাসপোর্টও জব্দ রাখা হয়েছে।
তথ্যভান্ডার ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম এবং দায়িত্ব হস্তান্তরসহ নানা বিষয়ে গড়িমসির কারণে টাইগার আইটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দায়িত্বশীল এ কর্মকর্তা জানান। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করার কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।
টাইগার আইটির পরিচালক এএইচএম রাশেদ সরোয়ার এ প্রসঙ্গে আমার দেশকে জানান, সম্প্রতি তাদের কিংবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ইসি থেকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কি না তাদের জানা নেই।
এনআইডি অনুবিভাগের ডিজি ও আইডিয়া প্রকল্পের সাবেক প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সালিম আহমেদ খান আমার দেশকে বলেন, ‘এনআইডির ডাটাবেজের তথ্যঝুঁকিসহ নানা অনিয়ম নিয়ে টাইগার আইটিকে আমার মেয়াদকালে অনেকবার চিঠি দিয়েছি। কিন্তু তারা এসব চিঠি আমলে নিত না। সব তারা নেতিবাচক হিসেবে দেখত এবং ইসিকে আন্ডারমাইন্ড করত।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গত ১৫ বছর একটি মাফিয়া চক্রের মাধ্যমে অরক্ষিত অবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে ১২ কোটি ৬১ লাখ নাগরিকের এনআইডি ডাটাবেজ। এ ডাটাবেজ ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাও (‘র’) ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনার সম্মতিতে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও তারিক সিদ্দিক ডাটাবেজটি ‘র’-এর হাতে তুলে দেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, টাইগার আইটির কর্ণধার জিয়াউর রহমান। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত এ জিয়াউরের সঙ্গে তারিক সিদ্দিকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তথ্যভান্ডারকে কাজে লাগিয়ে ঘুস হিসেবে তারিক সিদ্দিক কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে বিশ্বব্যাংকের তদন্তে উঠে এসেছে। স্মার্টকার্ড প্রকল্পে দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বিশ্বব্যাংক ২০১৯ সালে তারিক সিদ্দিকের নিয়ন্ত্রণাধীন টাইগার আইটিকে কালো তালিকাভুক্ত করে। ব্যাপক অভিযোগের পরও শেখ পরিবারের সঙ্গে সখ্য থাকায় টাইগার আইটি সব সময় ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। অতীতে কোনো কর্মকর্তা তথ্যভান্ডারকে সুরক্ষিত করতে চাইলে তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার নজির রয়েছে।
ইসির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটির কাছ থেকে এনআইডির তথ্যভান্ডার পৃথক করার চেষ্টা চলছে অনেক দিন ধরেই। নানা কারণে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পেরে উঠছে না ইসি। এখন ওই প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ডাটাবেজটি। তবে টাইগার আইটি কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা হস্তান্তরের চেষ্টা করছে। নানা প্রক্রিয়ার কারণে বিলম্ব হচ্ছে।