
চট্টগ্রামে তুচ্ছ ঘটনার জেরে মারামারি ও হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নতুন ভবন ও স্থাপনা নির্মাণে ইট-বালু সাপ্লাই বাণিজ্যের ঠিকাদারির সঙ্গে তারা জড়িত। তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন কথিত রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরা। গত বছরের ৫ আগস্টের আগে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা কিশোর গ্যাং সদস্যদের মদদ দিতেন। আওয়ামী লীগ পতনের পর এই উঠতি বয়সিদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা কব্জায় নিচ্ছেন।
চট্টগ্রামে অতীতের চেয়ে বেশি মাত্রায় বেপরোয়া কিশোর গ্যাং। মব সৃষ্টি করে নানা অপকর্ম করছে গ্যাংয়ের সদস্যরা। কেবল নগরী নয় জেলার বিভিন্ন উপজেলায় কিশোর গ্যাংয়ের দাপট দৃশ্যমান। সবশেষ শুক্রবার ফটিকছড়িতে চুরির অভিযোগে ব্রিজের রেলিংয়ের সঙ্গে বেঁধে তিন কিশোরকে নির্দয়ভাবে পেটানো হয়। হামলা ও মারধরে মা-বাবার সামনেই প্রাণ হারিয়েছে রিহান উদ্দিন ওরফে মাহিন নামে এক কিশোর। অন্য দুজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ফটিকছড়ির এ ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে, কিশোর গ্যাং কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।
চলতি আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা সূত্র জানায়, জুলাই মাসে জেলায় ডাকাতি দুটি, চাঁদাবাজি একটি, খুন সাতটি, অস্ত্র উদ্ধার সাতটি, অপহরণ দুটি, রাহাজানি/দস্যুতা তিনটি, প্রাণহানি/অপমৃত্যু ৭০টি, ধর্ষণ ১৯টি, নারী ও শিশু নির্যাতন ১৮টি, চুরি ২৪টি, অন্যান্য কারণে ২৬৪টি মামলাসহ মোট ৪১৭টি মামলা হয়েছে। এর আগের জুন মাসে জেলায় ৪০১টি মামলা হয়। এই হিসেবে জুলাই মাসে ১৬টি মামলা বেশি হয়েছে। একইভাবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় জুলাই মাসে ৪৮০টি মামলা হয়েছে। চাঁদাবাজি চারটি, ছিনতাই চারটি, খুন ৯টি, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার তিনটি, অপহরণ ছয়টি, রাহাজানি/দস্যুতা আটটি, প্রাণহানি/অপমৃত্যু ৫৮টি, ধর্ষণ ১৬টি, নারী ও শিশু নির্যাতন ৩৯টি, চুরির ৪৪টি ও মাদকের ১৫৬টি মামলা হয়। আর অন্যান্য ঘটনায় মামলা হয় ১৩৩টি। অথচ এর আগে জুন মাসের মামলার সংখ্যা ছিল ৩৯০টি। এই হিসাবে জুলাই মাসে ৯০টি মামলা বেশি হয়েছে। এসব ঘটনার অধিকাংশই কিশোর গ্যাং সদস্যরা জড়িত বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, ২০১৮ সালে নগরীর জামাল খান এলাকায় স্কুলছাত্র আদনান ইসফারকে গুলি করে হত্যার পর নগরীতে কিশোর গ্যাং আলোচনায় আসে। পরের বছর নগর পুলিশ এদের তালিকা করার কাজ শুরু করে। পুলিশের তথ্য মতে, গত ৬ বছরে ৫৪৮টি অপরাধের ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত। এছাড়া গত বছরের মার্চে সিএমপির করা এক জরিপে উঠে আসে চট্টগ্রাম নগরীতে সক্রিয় কিশোর গ্যাং রয়েছে প্রায় ২০০টি। এসব গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা এক হাজার ৪০০ জনের মতো। তাদের প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতায় ৬৪ ‘বড় ভাই’ থাকার কথাও জরিপে উঠে আসে। নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সামাজিক অস্থিরতা ও কিশোর গ্যাংয়ের উত্থানের কারণ খুঁজতে গিয়ে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার তথ্য পায় পুলিশ। এসব ছাত্র পর্নোগ্রাফি, সাইবার অপরাধ, ছিনতাই, চুরি, মাদক সেবন ও কেনাবেচা এবং অনলাইন জুয়ার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এক্ষেত্রে তারা বেছে নেয় স্কুলের সময়টা। পুলিশ জানায়, চট্টগ্রামের স্কুলগুলোতে অনুপস্থিত থাকা ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই জড়িয়ে পড়েছে অপরাধে।
গত ১৬ মে নগরীর হালিশহর থানাধীন নয়াবাজার এলাকায় দুই কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বে খুন হয় কলেজছাত্র ওয়াহিদুল আলম সাব্বির। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, ঘটনার দিন চারটি অটোরিকশায় করে এসে ‘পাইথন’ নামের কিশোর গ্যাংয়ের ২২ জন সদস্য সাব্বিরকে পিটিয়ে আহত করে। সাব্বিরের পেটে ছুরিকাঘাত করেছিলেন গ্যাংটির নেতা হিসেবে পরিচিত মো. আতাউল। ঘটনার ছয় দিন পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাব্বিরের মৃত্যু হয়। সাব্বির নিজেও ‘বিংগু গ্রুপ’ নামে একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য ছিল। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত আটজনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার রাতে হালিশহর এলাকা থেকে ছুরিকাঘাতকারী আতাউলকে র্যাব ও পুলিশ গ্রেফতার করে। সাব্বির হত্যাকাণ্ডের তদন্তে এই গ্যাং নেটওয়ার্ক উন্মোচিত হয়েছে। ধৃত কিশোর গ্যাং লিডার পুলিশকে বলেছে, ৫-১০ সেকেন্ডেই তারা সাব্বিরকে হত্যা করে।
গত শুক্রবার ভোরে ফটিকছড়ির কাঞ্চননগরে স্থানীয় চেইঙ্গার ব্রিজ এলাকায় মব তৈরি করে তিন কিশোরকে গণপিটুনি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় মারা যাওয়া রিহান উদ্দিন ওরফে মাহিনের পরিবারে শোকের মাতম থামছে না। ছেলেকে হারিয়ে মাহিনের বাবা লোকমান পাগলপ্রায়। তিনি ছেলের স্কুল ড্রেস, ব্যাগ, বই-খাতা জড়িয়ে ‘আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও, না হয় আমায় হত্যা করো’ বলে বিলাপ করছেন। তিনি জানান, ‘খুনিরা আমার সামনেই আমার কলিজার টুকরাকে আঘাতের পর আঘাত করেছে। আমি ছেলেকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু খুনিরা আমাকেও হত্যার উদ্দেশ্যে জখম করেছে। দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় আমার সন্তান প্রাণ হারিয়েছে। খুনিরা মাহিনকে এক ফোঁটা পানিও পান করতে দেয়নি। অথচ মাহিনের মা ছেলের জন্য গ্লাসে পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঘটনাস্থলে।’
এই হত্যাকাণ্ডকে পরিকল্পিত উল্লেখ করে খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে এলাকাবাসী। মাহিনের পরিবার খুনিদের শনাক্ত করে তাদের নাম ও ছবি পুলিশকে দিয়েছে। পরিবারের দাবি- পূর্বশত্রুতার জেরে স্থানীয় বাসিন্দা তৈয়বের নেতৃত্বে নাজিম, আজাদ, নোমান ও মহিউদ্দিন পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ঘটনার দিন রাতে পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত সাতজনকে আসামি করে মাহিনের মা খাদিজা বেগম থানায় মামলা করেছেন। এর মধ্যে নোমান ও আজাদকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
ফটিকছড়ি থানার ওসি নুর আহমদ যুগান্তরকে বলেন, মাহিন হত্যাকাণ্ডে জড়িত দুজনকে গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।