
দৈনিক খাবারে প্রয়োজনীয় পুষ্টির চেয়ে অনেক কম পাচ্ছে দেশের ৮৫ হাজার কারাবন্দি। চাহিদার চেয়ে কম এবং নিম্নমানের খাবার পাচ্ছে বন্দিরা। এতে পুষ্টির ঘাটতি বাড়ছে। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। একই সঙ্গে মানসিক সমস্যাসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেক কারাবন্দি। সুস্থ-সবল একজন মানুষ অপরাধের কারণে কারাভোগের পর স্বাস্থ্য হারিয়ে দুর্বল অবস্থায় নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসছে। অপ্রতুল বরাদ্দ, নজরদারির অভাব, বন্দিদের প্রতি এক ধরনের অবহেলার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি কারাবন্দি খাবারের তালিকায় মাছ ও মাংসের পরিমাণ বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সব কারাবন্দির খাবারের তালিকা মাছ ও মাংসের পরিমাণ বিদ্যমানের চেয়ে ৫০ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্তে সম্মতি দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। সম্প্রতি তিনি এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন। নতুন খাবারের তালিকা বাস্তবায়নের ফলে বর্তমান এ খাতের ব্যয় ৩৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৫৬ কোটি ৩৮ লাখে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
নীতিগত অনুমোদন দেওয়া প্রস্তাবে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সংশ্লিষ্ট সব প্রশাসনিক ও আর্থিক বিধিবিধান যথাযথ অনুসরণ করতে হবে। তবে চলতি অর্থবছর এ বাবদ অতিরিক্ত বরাদ্দ দাবি করা যাবে না। তিনি আরও বলেছেন, দৈনিক মাছ ও মাংসের প্রাধিকারসংক্রান্ত জেলকোডের সংশ্লিষ্ট ১০৯৫ ধারা প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে হবে।
বর্তমান খাবারের তালিকায় একজন কারাবন্দি দৈনিক মাছ ৩৬.৪৫ গ্রাম বা গরুর মাংস ৩৮.৭৮ গ্রাম বা খাসি বা ছাগীর মাংস ৩৬.৪৫ গ্রাম বা মুরগির মাংস পাচ্ছে ৩৭.৯০ গ্রাম। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিগত অনুমোদনের পর কারাবন্দিদের নতুন খাবারের তালিকায় মাছ ৫৪.৬৮ গ্রাম, গরুর মাংস ৫৮.১৭ গ্রাম, খাসি বা ছাগীর মাংস ৫৪.৬৮ গ্রাম এবং মুরগির মাংস ৫৬.৮৫ গ্রাম পাবেন।
কারা অধিদপ্তর গঠিত কমিটি খাবার তালিকা পুনর্নির্ধারণের আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে পর্যালোচনা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। এতে দেশের সিভিল সার্জন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের মতামত নেওয়া হয়েছিল। এরপর অর্থ বিভাগ এসব প্রতিবেদন ও নিজস্ব বিশ্লেষণ এবং পর্যালোচনার পর তা অর্থ উপদেষ্টার কাছে উপস্থাপন করে। এতে দেখা যায়, পরিসংখ্যান বিভাগের মতে, ‘হাউজহোল্ড ইনকাম ও এক্সপেন্ডিচার সমীক্ষা-২০২২’-এর হিসাব অনুযায়ী দেশের মানুষ গড়ে দৈনিক ৬৭.৮ গ্রাম মাছ ও ৪০ গ্রাম মাংস গ্রহণ করে। কিন্তু কারাবন্দিরা পাচ্ছেন ৩৬.৪৫ গ্রাম মাছ ও ৩৮ দশমিক ৭৮ গ্রাম মাংস। সে বিবেচনায় মাছ ও মাংসের পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে।
জানতে চাইলে সিনিয়র পুষ্টিবিদ সিরাজাম মুনিরা যুগান্তরকে জানান, মানুষের শরীরে প্রতিকেজি ওজনের জন্য ০.৮০ থেকে ১ গ্রাম পর্যন্ত প্রোটিনের প্রয়োজন। এখন ৭০ কেজি ওজনের মানুষের প্রয়োজন ৬৫-৭০ গ্রাম। কিন্তু ৫৫ গ্রাম মাছ বা মাংস থেকে পুষ্টি আহরণ হবে প্রায় ২৬ গ্রাম। প্রয়োজনীয় বাকি প্রোটিনের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে কয়েদিদের মাছ ও মাংসের সঙ্গে ডাল ও ডিম দেওয়া হলে দৈনিক প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ হবে। না হলে শরীরের পেশি, ওজন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে মানসিক রোগের প্রবণতা আরও বাড়বে। যদিও কয়েদিরা ডিপ্রেশনেই বেশি ভুগে থাকেন।
জানা গেছে, কারাবন্দিদের খাবারের তালিকায় পুষ্টির পরিমাণ বাড়ানোর বিষয়টি প্রথমে নজরে নিয়ে আসেন জেলা প্রশাসকরা। ডিসি সম্মেলনে তারা বিষয়টি উত্থাপন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে দৈনিক মাছ ও মাংসে প্রাধিকার বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এরপর তা বাস্তবায়নের জন্য চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন হয়। ওই কমিটি বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জনের কাছে মত চেয়ে চিঠি দেয়। সিভিল সার্জনরা কারাবন্দিদের মাছ ও মাংস ২৫ শতাংশ অ্যালাউন্সসহ ৫০ থেকে ১১২.৫ গ্রাম পর্যন্ত বাড়ানোর সুপারিশ করে। সিভিল সার্জনদের মতামত ছাড়াও একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ বাংলাদেশি মানুষের প্রয়োজনীয় ক্যালরি উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণের লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ মত নিয়েছেন কারা অধিদপ্তরের গঠিত কমিটি। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট মতামতে বলেছে, ‘দৈনিক একজন মানুষের জন্য দুপুরে মাছ ৮০ গ্রাম এবং রাতে ৮০ গ্রাম মাংস প্রয়োজন।’
কারাবন্দিদের খাবার নিয়ে দুটি সংস্থার রিপোর্ট পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে কারা অধিদপ্তরের গঠিত কমিটি। সে কমিটি একজন বন্দির জন্য দৈনিক মাছের পরিমাণ ৩৬.৪৫ থেকে বাড়িয়ে ১৮০ গ্রাম, গরুর মাংস ৩৮.৭৮ থেকে বাড়িয়ে ১৮০ গ্রাম, খাসির মাংস ৩৬.৪৫ থেকে বাড়িয়ে ১৭০ গ্রাম, মুরগির মাংস ৩৭.৯০ থেকে বাড়িয়ে ১৬০ গ্রাম দেওয়ার সুপারিশ করেছে।
অর্থ বিভাগ পর্যালোচনা করে দেখেছে, কারা অধিদপ্তরের কমিটির প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে বিদ্যমান ব্যয় প্রায় ৩৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৫৫ কোটি টাকায় দাঁড়াবে, অর্থাৎ অতিরিক্ত ব্যয় গুনতে হবে ১১৮ কোটি টাকা। এছাড়া অর্থ বিভাগ বিদ্যমান মাছ ও মাংসের পরিমাণ ৫০ শতাংশ এবং ১০০ শতাংশ বাড়ানোর দুটি হিসাব বের করেছে। সে হিসাবে দেখা গেছে বিদ্যমান প্রাপ্যের তুলনায় খাবার দ্বিগুণ করা হলে বিদ্যমান ব্যয় ৩৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৭৫ কোটি টাকায় উঠবে, অর্থাৎ অতিরিক্ত ৩৭ কোটি টাকা বেশি গুনতে হবে। এছাড়া ৫০ শতাংশ খাবার বাড়ানো হলে সেটি ৫৬ কোটি টাকায় উঠবে অর্থাৎ অতিরিক্ত ১৯ কোটি টাকা বেশি গুনতে হবে। শেষ পর্যন্ত ৫০ শতাংশ খাবারের পরিমাণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়।
কারা অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘কারাবন্দিদের খাবারের মেন্যুতে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ দিনের খাবারের ভাতাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। সকালের নাশতায়ও পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে পুষ্টিকর খাবারের ক্ষেত্রে কিছুটা কমতি রয়েছে। বিশেষ করে মাছ-মাংসের পরিমাণের যে বিষয়টি, এটি নিয়ে আমরাও কাজ করছি। আবার বন্দিদের যে পরিমাণ ডাল দেওয়া হয়, সেটা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি। এ ধরনের বিষয়গুলো সমন্বয় করে কারাবন্দিদের জন্য পরিমাণমতো পুষ্টিকর খাবার সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে।