
পুলিশ বাহিনীর কাজে স্বচ্ছতা আনতে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বডিক্যাম কেনা হচ্ছে। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু ভোট গ্রহণের সুবিধার্থে এটির আনুষ্ঠানিক ব্যবহার শুরু হবে। এসব ক্যামেরা দেশের ৪৭ হাজার ভোটকেন্দ্রে ব্যবহার করা হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহারসহ সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এসব ক্যামেরায় ভিডিও, অডিও, অ্যালার্ম সিস্টেমের ব্যবস্থা থাকবে।
একজন পুলিশ কনস্টেবল নিজের শরীরে এ ক্যামেরা বহন করবেন। তার সঙ্গে ফোর্স মোতায়েন করা হবে। ক্যামেরা থেকে লাইভ দেখার ব্যবস্থাও থাকবে। নির্বাচনের পর দেশের সব থানায় ক্যামেরাগুলো বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহার করতে হবে। যে কোনো ধরনের অভিযানে থাকবে ক্যামেরার ব্যবহার। বাহিনীতে সংস্কার ও কাজের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করার অংশ হিসেবে এই বডিক্যাম ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ কনস্টেবলরা নির্বাচনের সময় প্রতিটি কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের সময় ডিভাইসগুলো (বডিক্যাম) তাদের বুকে পরবেন। সবমিলিয়ে কমবেশি এক লাখ ৩০ হাজার কনস্টেবলকে ট্রেনিং দেওয়া হবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে একটি ক্যামেরা থাকবে। কনস্টেবলের সঙ্গে প্রয়োজনীয় ফোর্স থাকবে। নেতৃত্বে থাকবেন ক্ষেত্র বিশেষে পুলিশ পরিদর্শক, উপপরিদর্শক কিংবা সহকারী উপপরিদর্শক। ক্যামেরা দিয়ে একই সঙ্গে ভিডিও এবং অডিও রেকর্ড করা যাবে। ব্যাটারি একবার চার্জ দিলে একটানা ১০ ঘণ্টা রেকর্ড করা যাবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একসঙ্গে এক হাজার লাইভ স্ট্রিমিং চ্যানেলে লাইভ দেখানো যাবে।
কার্যক্রম তিনটি স্থান থেকে মনিটরিং করা হবে। প্রথমত, সংশ্লিষ্ট থানায় মনিটরিং ব্যবস্থা থাকবে। ক্যামেরা নিয়ে নির্দিষ্ট ফোর্স কোথায় রয়েছে, সেখান থেকে তাদের অবস্থান পুরোপুরি মনিটরিং করা হবে। দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) অফিসে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। তৃতীয়ত, পুলিশ সদর দপ্তরে সারা দেশের সব স্থানের ক্যামেরার কার্যক্রম মনিটরিং করার ব্যবস্থা থাকছে। এ ক্ষেত্রে সদর দপ্তরে স্থাপন করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় কমান্ড সেন্টার। ক্রমান্বয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সুবিধা নেওয়ার প্রযুক্তি স্থাপন করা হবে এতে।
সূত্র জানায়, ক্যামেরার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মনিটরিং সেন্টারগুলোতে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করার সুবিধা থাকবে। নিয়মিতভাবে সব ধরনের যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বডিক্যাম ব্যবহারকারী ওয়াকিটকির মতো কথা বলতে পারবেন। কোথাও কোনো সমস্যা দেখা দিলে, বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হলে এআইয়ের মাধ্যমে সেট করা অ্যালার্ট কিংবা অ্যালার্ম বেজে উঠবে সংশ্লিষ্ট থানা, পুলিশ সুপারের কার্যালয় এবং কেন্দ্রীয় কমান্ড সেন্টারে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ক্যামেরাগুলোতে ফেস রিকগনিশন (চেহারা চিহ্নিতকরণ) সিস্টেম থাকবে। একবার এই ক্যামেরায় কোনো অপরাধীর ফেস ধরা পড়লে, পরবর্তী সময়ে যে কোনো সময় ওই অপরাধী অপরাধ করে আটক হলে তার চেহারা সহজে শনাক্ত করবে এই ক্যামেরা। উন্নতমানের ক্যামেরায় নাইট ভিশন প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে রাতে কিংবা অন্ধকার স্থানে যে কোনো অপরাধীর এবং ঘটনাস্থলের ভিডিও ধারণ করলে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাবে। সারা দেশের সংগ্রহ করা সব ভিডিও কেন্দ্রীয়ভাবে পুলিশ সদর দপ্তরে সংরক্ষিত থাকবে। তাই যে কোনো জেলায় প্রয়োজন অনুসারে ডেটা ট্রান্সফার করা যাবে।
পাশাপাশি জেলার মনিটরিং সেন্টারে থানাগুলোর অভিযানের তথ্য সংরক্ষিত থাকবে। থানায় রক্ষিত থাকবে সেখানকার সব অভিযানের তথ্য। ক্যামেরার অবস্থান জানা যাবে লাইভ লোকেশনের মাধ্যমে। ক্যামেরা কোন দিকে মুভ করছে, তা লাইভে দেখার ব্যবস্থা থাকছে। জিপিএস ব্যবহার করে লাইভ লোকেশন জানা যাবে। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হবে ফোর-জি নেটওয়ার্ক। নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যালার্ম বেজে উঠবে। জরুরি প্রয়োজন হলে বাড়তি ফোর্স যাবে ঘটনাস্থলে। তা ছাড়া আশপাশে টহল ফোর্স থাকে, সেখানে থেকেও ফোর্স চলে যাবে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনের পর সারা দেশের থানাগুলোতে এই ক্যামেরাগুলো দেওয়া হবে। সাধারণত দেশের সব থানায় পেশাদার অপরাধীদের তালিকা থাকে। এ তালিকা আপডেট করে থানাগুলোতে অপরাধীদের ডিজিটাল ডেটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে। বডিক্যামের জন্য গঠিত কেন্দ্রীয় কমান্ড সেন্টারে দেশের সব থানার অপরাধীদের বিস্তারিত ডেটাবেজ থাকবে। কোনো অভিযানে গেলে কিংবা অপরাধ বা ঘটনার ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেলে সেখানে ডেটাবেজে সংরক্ষিত অপরাধীদের ছবি দেখে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপরাধীদের চেহারা চিহ্নিত করার ব্যবস্থাও থাকবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নিয়মিত কাজে এই বডি ক্যামেরার ব্যবহারের ফলে পুলিশের কাজে অনেক বেশি স্বচ্ছতা আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গুমসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো গুরুতর অপরাধ এবং তথ্য লুকানোর সুযোগ কমে আসবে বলে মনে করছেন তারা। নির্বাচন-পরবর্তী সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এবং যে কোনো অভিযানে বডি ক্যামেরা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার জন্য আইনি ভিত্তি দেওয়া হবে।
বর্তমান সরকারের অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে গত ৯ আগস্ট ঢাকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে এক উচ্চপর্যায়ের সভায় নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন-পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বডি ক্যামেরা ব্যবহার এবং তা দ্রুত কার্যকর করতে আলোচনা করা হয়। সভায় প্রধান উপদেষ্টা বডিক্যাম দ্রুত কেনা এবং হাজার হাজার পুলিশ কর্মীর জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই সব ভোটকেন্দ্রে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। খরচ যাই হোক না কেন, আমাদের লক্ষ্য হলো ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ করা।’
এ ছাড়া আসন্ন ভোটের জন্য একটি নির্বাচনি অ্যাপ চালু করার পরিকল্পনার কথাও জানানো হয়। অ্যাপটি ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ওপর বিশদ তথ্য দেবে, এর মধ্যে প্রার্থীর বিবরণ, ভোটকেন্দ্রের আপডেট এবং অভিযোগ জমা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। প্রধান উপদেষ্টা কর্মকর্তাদের অ্যাপটি দ্রুত চালু করার এবং দেশের ১০ কোটিরও বেশি ভোটারের জন্য এটি ব্যবহারবান্ধব কি না, তা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেন।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনার পরদিন তার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব সাংবাদিকদের জানান, ৪৭ হাজার বডি ক্যামেরা, সংগ্রহের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এই ডিভাইসগুলো হাজার হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা জোরদার করবে। ক্যামেরা সংগ্রহের জন্য জার্মানি, চীন এবং থাইল্যান্ডের তিনটি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বাংলাদেশ। তৈয়্যব বলেন, পুলিশকে প্রশিক্ষণ দিতে আগেভাগেই ক্যামেরাগুলো আনতে চায় সরকার। অক্টোবরের মধ্যে বডিক্যামগুলো আমরা সংগ্রহ করতে চাই, যেন পুলিশ বাহিনী এগুলোর এআই সক্ষমতাসহ মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পেতে পারেন।’