
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের ওয়াকিটকির বার্তা ফাঁস করার অভিযোগে গ্রেপ্তার কনস্টেবল অমি দাশের মতো বাহিনীতে আরো কেউ আছে কি না, তা নিয়ে চলছে তদন্ত। এরই মধ্যে গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ আগস্ট রাতে চট্টগ্রাম বন্দরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলায় গুরুতর আহত হন এসআই আবু সাঈদ। পরদিন কমিশনার ওয়াকিটকিতে নির্দেশ দেন—পুলিশের প্রতিটি টহল পার্টি অস্ত্রসজ্জিত হয়ে বের হবে এবং অস্ত্র বের করামাত্র গুলি চালাবে। অপারেটর অমি দাশ নির্দেশনাটির ভিডিও ধারণ করেন এবং সেটি ছড়িয়ে দেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। হঠাৎ করেই অভ্যন্তরীণ বার্তাটি বাইরে চলে আসে। এরপর শুরু হয় তদন্ত। অবশেষে ১৭ আগস্ট রাতে খুলশী থানার অপারেটর অমি দাশকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা করা হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, অমি দাশ যেভাবে কমিশনারের সংবেদনশীল নির্দেশনা ভিডিও করে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা হঠাৎ করে করা কোনো কাজ নয়। এর পেছনে কার প্ররোচনা বা নেটওয়ার্ক কাজ করেছে, তার অনুসন্ধান চলছে। এরই মধ্যে তার কললিস্ট, মোবাইল ডেটা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, অমি দাশ স্বীকার করেছেন তিনি ভিডিও করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো—কেন করেছেন, কার জন্য করেছেন? আমরা আশঙ্কা করছি, বাহিনীর ভেতরে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত কিছু ব্যক্তি থাকতে পারেন, যারা অপরাধী বা রাজনৈতিক নেটওয়ার্ককে তথ্য সরবরাহ করছেন। তাদের শনাক্ত করাই এখন প্রধান লক্ষ্য।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে বিশেষ নজরদারি শুরু হয়েছে। ফোর্সের ভেতরে যেসব সদস্য রাজনৈতিক প্রভাবে চাকরিতে প্রবেশ করেছেন কিংবা এখনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, তাদের ওপর বিশেষ পর্যবেক্ষণ চালানো হচ্ছে। কারণ, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বা কৌশলগত বার্তা ফাঁসের মতো ঘটনা একাধিকবার ঘটলে পুরো বাহিনীই অচল হয়ে পড়তে পারে।
ছাত্রলীগ নেতা থেকে কনস্টেবল
তদন্তে উঠে এসেছে, অমি দাশ দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের অভিযানের খবর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতাদের আগে জানিয়ে দিতেন। এতে একাধিক অভিযান ব্যর্থ হয়েছে, পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীরা।
অমি দাশের অতীত ঘেঁটে দেখা যায়, তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। তার বাবা রাজিব দাশও পটিয়া পৌর আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে, প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা সামশুল হক চৌধুরী, প্রয়াত মোসলেম উদ্দিন আহমদ কিংবা সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ ছবি।
এমন রাজনৈতিক পরিচয়ের জোরেই ২০১৩ সালে কনস্টেবল পদে নিয়োগ পান অমি দাশ। এরপর ধাপে ধাপে তার স্থান হয় টেলিকম ইউনিটে। সর্বশেষ খুলশী থানার অপারেটর হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এখানে থেকেই তিনি পুলিশের অভ্যন্তরীণ গোপন বার্তায় প্রবেশাধিকার পান।
খুলশী থানার ওসি মিজানুর রহমান জানান, অমিকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। তাকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে। মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটকে দেওয়া হয়েছে।
অমি দাশ কীভাবে পুলিশের গোপন বার্তা ফাঁস করতেন
চট্টগ্রামের অভিজ্ঞ এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অমি দাশ কেবল একজন কনস্টেবল ছিলেন না, তিনি একটি সংগঠিত নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে কাজ করতেন। এ ধরনের চক্রের কাজের ধরন অনেকটা ‘ভেতরের লোক’ বা ইনসাইডার হিসেবে। তারা পুলিশের ইউনিটে ঢুকে পড়ে, তারপর ধীরে ধীরে সংবেদনশীল জায়গায় নিজেদের অবস্থান তৈরি করে।
তিনি বিষয়টির ব্যাখ্যা করে বলেন, পুলিশের অভ্যন্তরে টেলিকম, কন্ট্রোল রুম বা থানার ডিউটি অফিসার পদগুলোয় কর্মরত সদস্যরা মূলত সবচেয়ে বেশি তথ্যের ভেতরে থাকেন। এ ইউনিটগুলো থেকেই অভিযান পরিচালনার সময় গোপন নির্দেশনা ওয়াকিটকি বা সিগন্যালের মাধ্যমে পৌঁছে যায় মাঠপর্যায়ে। অমি দাশ এ সুবিধাই কাজে লাগাতেন। খুলশী থানার অপারেটর হিসেবে বসে তিনি কমিশনারের প্রতিটি নির্দেশ শুনতে পারতেন। শুধু শোনাই নয়, নিজের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে তিনি বার্তাগুলো গোপনে রেকর্ড করতেন। একবার রেকর্ড করা হলে সেগুলো আর ওয়াকিটকি সিস্টেমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত না।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, রেকর্ড করার পরপরই তথ্য সরাসরি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হতো আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার কাছে। কিছু ক্ষেত্রে ফেসবুক মেসেঞ্জারেও পাঠাতেন। এর বাইরে কয়েকটি নির্দিষ্ট গ্রুপ ছিল, যেখানে ছাত্রলীগের নিষিদ্ধ অংশ এবং মাদক ব্যবসায়ীরা যুক্ত ছিল। সেখানে তথ্য শেয়ার হয়ে যেত কয়েক মিনিটের মধ্যেই। আমাদের হাতে প্রমাণ আছে, কমিশনারের নির্দেশ ফাঁস হওয়ার পর রাতারাতি কয়েকটি অভিযান ব্যর্থ হয়। অভিযানের খবর আগেভাগেই পেয়ে টার্গেট সন্ত্রাসী বা মাদক ব্যবসায়ীরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑঅমি দাশ একাই কি এভাবে বার্তা পাঠাচ্ছিলেন, নাকি আরো কেউ তাকে সহায়তা করছিলেন। কারণ, একজন কনস্টেবল একা এতবড় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সচরাচর করেন না। এর পেছনে রাজনৈতিক যোগাযোগ ও সুরক্ষা থাকলেই এমন কাজ করা সম্ভব।
প্রাথমিক তদন্তেও তথ্য পাচারের প্রমাণ
চট্টগ্রামের খুলশী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তফা কামাল গত ২১ আগস্ট আদালতে রিমান্ডের আবেদনপত্রে প্রাথমিক তদন্তে উল্লেখ করেন, খুলশী থানার গেটের সিঁড়িতে অবস্থানকালে কনস্টেবল অমি দাশ সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজের কৌশলগত নির্দেশনার ভিডিও ধারণ করেন, যা তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। ১৭ আগস্ট রাতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। ভিডিওধারণে ব্যবহৃত মোবাইল ফোনসেটটি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন।
আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী জানান, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট আইনের মামলায় অমি দাশকে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
আইনবিদ, কলামিস্ট ও মানবাধিকার সংগঠক অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলেন, কনস্টেবল অমি দাশ যদি সত্যিই কমিশনারের নির্দেশ ফাঁস করে থাকেন, তবে এটি শৃঙ্খলাভঙ্গ ও গুরুতর অপরাধ। রাষ্ট্রের গোপনীয় তথ্য ফাঁস করা গুরুতর অপরাধ। এই আইনে মামলা হওয়া যৌক্তিক।
চট্টগ্রামের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের ডিসি মো. গোলাম রুহুল কুদ্দুস আমার দেশকে বলেন, মামলাটি তদন্তের জন্য আমাদের কাছে দেওয়া হয়েছে। এই চক্রে আর কারা জড়িত, সবকিছু তদন্ত করা হবে।