
প্রকৃতিক নানা দুর্যোগে নাকাল খুলনা উপকূলের কৃষিজীবীরা। অতিবৃষ্টি, নদীভাঙন, লবণাক্ত ও জলাবদ্ধতা এ এলাকার নিত্যসঙ্গী। গত জুন ও জুলাই মাসের টানা বৃষ্টিতে খুলনায় ফসল, সবজি ও আমনের বীজতলা নষ্ট হয়েছে। পানিতে তলিয়ে খুলনার ১৬০ হেক্টর জমির রোপা আমন বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ঝুঁকিতে পড়েছেন খুলনার কৃষকরা।
কৃষকরা একাধিকবার বীজতলা তৈরির চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু টানা বৃষ্টি কৃষকদের চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়। তাই শেষ মুহুর্তে এসে পাইকগাছার এক কৃষক দম্পতি ভেলায় ভাসমান বীজতলা তৈরি করে পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্রিয় হন। এ দম্পতির চেষ্টা সফলতা পেয়েছে। যা আগামীতে উপকূলীয় এলাকার কৃষকদের কাছে মডেল হয়ে উঠতে পারে। এ মডেল নিয়ে চিন্তা করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও। এ বছর টানা বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় বীজতলা নষ্ট হওয়ায় আমন রোপনে দেরি হয়েছে। ভাসমান বীজতলা পদ্ধতি অনুসরণ করলে আগামীতে ধান চাষ বিলম্বিত হবে না।
গত জুন জুলাই মাসে মৌসুমে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতে উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার। দুদফা বীজতলা দিয়েও তা নষ্ট হয়। এ অবস্থায় কৃষকরা উদ্বিগ্ন হন। এমন পরিস্থিতিতে ভেলায় ভাসমান বীজতলার উদ্যোগ নেন পাইকগাছা উপজেলার নোয়াকাটী গ্রামের রোকেয়া পারভীন ও আব্দুস কুদ্দুস সম্পত্তি। বৃষ্টিতে নষ্ট হওয়া কলাগাছ, বাঁশ, মাটি ব্যবহার করে তৈরি করেন ভাসমান বীজতলা। এ ব্যাতিক্রম উদ্যোগই এখন দুর্যোগ কবলিত কৃষকদের নতুন আলো দেখাচ্ছে।
কৃষক রোকেয়া পারভীন বলেন, “বৃষ্টির জন্য কয়েক দফায় প্রায় ১০০ কেজি বীজ ধান নষ্ট হয়। কোন কুল-কিনারা পাচ্ছিলাম না, অ্যাওসেড'র কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে কলা গাছের ভেলা বানিয়ে কাদমাটি তুলে ব্রি-৭৫ আমন ধানের বীজ ফেলি। একটি বীজও নষ্ট হয়নি। মাত্র ১৫দিনে চারা রোপণ করার মতো হয়ে গেছে। মাটিতে করা বীজতলা থেকেও ভালো ও বড় চারা উঠেছে। আশেপাশের কৃষকরা এটা দেখে উজ্জীবিত হয়েছেন। তারা আগ্রহ দেখাচ্ছেন আগামীতে এমন পদক্ষেপ নেয়ার। তিনি বলেন, এ ব্যাতিক্রমী উদ্যোগ নিলে আগামীতে আর সমস্যা হবে না। প্রকৃতিক দুর্যোগের জন্য আর বীজতলা তৈরীর জন্য বসে থাকতে হবে না। আর সময়মই ধান চাষ করা সম্ভব হবে।”
রোকেয়ার স্বামী আব্দুল কুদ্দুস খান বলেন, “আমাদের কাজ দেখে প্রথমে সবাই পাগল বলছিল। বলছিল কলাগাছের ভেলায় ধান হলেতো কারো জমি দরকার ছিল না। কিন্তু এখন সবাই অবাক। এখানে কোন সার-কীটনাশকও লাগেনি। এমন ধানের চারা জমিতেও আর কখনো দেখা যায়নি। শুধু আমরা না, এ পদ্ধতিতে গ্রামের সবাই খুশি।”
নোয়াকাটী গ্রামের কৃষক কবির মোড়ল বলেন, “মাত্র ১০দিনে ৩/৪ ইঞ্চি ধানের চারা তৈরি হয়েছে। যা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে আমার বীজতলা নষ্ট হয়েছে। তাই ধান চাষ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছি। আগামীতে এ পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি করবো।”
কৃষক আব্দুল্লাহ মোড়ল জানান, চলমান আমন মৌসুম বৃষ্টির কারণে একমাস দেরি হয়েছে। সামনে আর সমস্যা হবে না। কলার ভেলা বা অন্য মাধ্যমে ভাসমান মাচা তৈরি করে বীজতলা করা যাবে। এতে সার-কীটনাশকের ব্যবহার করতে হচ্ছে না। এই পদ্ধতি বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে দিলে কৃষক উপকার পাবে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অটোক্রোপ কর্মকর্তা রুহুল আমিন বিষ্ময় প্রকাশ করে বলেন, “কলাগাছের ভেলায় বীজতলা কৃষকদের স্বপ্ন দেখাবে। এই দম্পতির এ ব্যাতিক্রমি চিন্তা মডেল হয়ে উঠতে পারে।”
অ্যাওসেড'র কমিউনিটি মোবালাইজার শুভঙ্কর বিশ্বাস বলেন, ২০ বছরের মধ্যে এ বছর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এতে পাইকগাছাসহ খুলনা অঞ্চলে আমনের বীজতলা কয়েক বার নষ্ট হয়। এ অবস্থা থেকে ভাসমান বীজতলা তৈরির বিষয়টির ভাবনা, যা কৃষকরা সফল বাস্তবায়ন করেছেন। আগামী দিনে ভাসমান ভেলা জলাবদ্ধতা অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন দেখাবে।
খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, টানা বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় খুলনায় ১৬০.৫৫ হেক্টর রোপা আমন ধানের বীজতলার ক্ষতি হয়েছে, পাইকগাছা উপজেলায় রোপাআমন ধানের বীজতলার ক্ষতি হয়েছে ৬৫ হেক্টর। খুলনায় রোপাআমন বীজতলার লক্ষ্যমাত্রা ৫৩২৫ হেক্টর, এ পর্যন্ত অর্জিত ৫০৭৫ হেক্টর। বৃষ্টির কারণে খুলনায় ২০.৮৭০ হেক্টর ফসলের মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮৪৮ হেক্টর। ১৩,০৭১ জন কৃষকের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২৭ কোটি ৬৫ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।
পাইকগাছা ক্লাইমেট জার্স্টিস ফোরামের সভাপতি অধ্যক্ষ রমেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, “ভাসমান বীজতলাটি দেখেছি। বৈশ্বিক জলবায়ূ পরিবর্তন মোকাবেলায় আমাদের কৃষক দম্পত্তির এমন উদ্যোগ নি:সন্দেহে আশাব্যাঞ্জক। তাদের এ সফলতা শুধু খুলনায়ই নয়, সারাদেশের মানুষের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। ভাসমান বীজতলা সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষকের বার বার বীজ ক্রয়ে আর্থিক ক্ষতি লাঘব হবে। পাশাপাশি মৌসুমের শুরুতে দুর্যোগ মোকাবেলা করে ধান চাষ করতে পারবেন।”
খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন, “এ বছর বীজতলা নষ্ট হওয়ায় আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ইতিমধ্যে বিনা ও ব্রি থেকে রোপা আমন ধানের বীজ সংগ্রহ করে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। পার্টনার প্রকল্পের প্রদর্শনীভুক্ত কৃষকের সংরক্ষিত ব্রিধান ১০৩ এর বীজ ধান দিয়ে বীজতলার ক্ষতি পূরণ করা হয়েছে।”
তিনি জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আশা করা যায় বীজতলার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে। আমনের লক্ষ্যমাত্রা ৯৩২৭০ হেক্টর। এ পর্যন্ত ২১% জমিতে রোপন সম্পন্ন হয়েছে। উপকূলীয় তিন উপজেলা কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপে রোপন কার্যক্রম ১০-১৫ দিন বিলম্বিত হতে পারে। তিনি বলেন, কৃষকদের ঝুকি কমাতে আগামীতে ভেলা বা বিকল্প কোন পদ্ধতিতে বীজতলা করার পরিকল্পনা থাকবে। পাশাপাশি উচু এলাকায় বীজ তৈরি করে ক্ষতি হওয়া কৃষকদের সরবরাহ করার পরিকল্পনাও থাকবে।