
দীর্ঘ ১২ বছর আগে দেশবরেণ্য ইসলামি চিন্তাবিদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দিতে এসে অপহরণ শিকার সুখরঞ্জন বালী ওই ঘটনায় শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ এবং সাবেক প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্তসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কাছে হাজির হয়ে তিনি এ অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযুক্ত বাকিদের মধ্যে অন্যতম হলেনÑতৎকালীন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক সংসদ সদস্য একেএম আউয়াল, ট্রাইব্যুনালের সাবেক চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সাবেক প্রধান মো. সানাউল হক, তদন্তকারী কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন প্রমুখ ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বরাবর অভিযোগ দাখিল করে বিষয়টি তিনি সাংবাদিকদের জানান। তিনি জানান, শেখ হাসিনার নির্দেশেই তাকে অপহরণ করা হয়। ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর আইসিটি চত্বর থেকে তাকে তুলে নেওয়া হয়। তখন তারা বলে, ‘শুয়োরের বাচ্চা, তোকেই তো আমরা খুঁজছি।’ পরবর্তীতে তারা আমাকে চোখ বেঁধে বিএসএফের হাতে তুলে দেয়। ভারতের কারাগারেও আমার ওপর প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়।
অভিযোগ গ্রহণ করে চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অনেককে গুম করা হয়। আদালত চত্বর থেকেও গুম করা হয়। সুখরঞ্জন বালী এমনই একজন গুম হওয়া ব্যক্তি।
সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দেওয়ায় অপহরণ করা হয়
ট্রাইব্যুনালে দেওয়া অভিযোগপত্রে সুখরঞ্জন বালী বলেন, আমার ভাই বিশাবালীকে (বিশেশ্বর বালী) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করেছিল। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের দিকে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত তৎকালীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন আমাকে ’৭১-এ আমার ভাই বিশাবালীর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চান। আমি তাকে বিশ্বাস করে প্রকৃত ঘটনা বলি। কিন্তু হেলাল উদ্দিন আমাকে আমার ভাইয়ের হত্যাকারী হিসেবে প্রকৃত হত্যাকারীদের নামের সঙ্গে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নামও বলতে চাপ প্রয়োগ করেন। সাঈদীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বলেন। আমি হেলাল সাহেবকে তখনই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেই, সাঈদী হুজুর আমার ভাই বিশাবালী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না। সুতরাং তার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় ।
কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল সাহেব জোরপূর্বক রাজি করাতে একপর্যায়ে আমাকে শারীরিক নির্যাতন করতে থাকেন। এরপর হেলাল উদ্দিন আমাকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি করাতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি একেএম আব্দুল আউয়াল, পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেককে ডেকে আনেন। তারা আখতারুজ্জামান যুলু ও কানাই লালা বিশ্বাসের নেতৃত্বে সাইদুল্লাহ লিটন, রেজাউল করিম শিকদার মন্টু, মিজানুর রহমান তালুকদার, সুমন সিকদার, দিলীপ মাঝি, রাজ্জাক খান বাদশা, মতিউর রহমান, যুবা, শাহজাহান খান তালুকদার, মাসুদ আহমেদ রানা, শেখ ফিরোজ আহমেদ, গোলাম মাওলা নকিব, আমিনুল ইসলাম মিরন, ইরতিজা হাসান রাজু, খায়রুল ইসলাম মিঠু, মজনু তালুকদার, মৃধা মো. মনিরুজ্জামান, কেএম মোস্তাফিজুর রহমান বিপ্লব, রাসেল পারভেজ রাজাসহ ছাত্রলীগ-যুবলীগের আরো কিছু লোককে তখন পিরোজপুর রাজশদী স্কুলে হাজির করে। তারা সেখানে উপস্থিত হয়েই আমাকে নানারকম চাপ ও ক্রমাগত হুমকি দিতে থাকে ।
ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে উঠিয়ে নেয় সাদা পোশাকের পুলিশ
আমি সাক্ষ্য দিতে রাজি না হলে এমপি আউয়াল ও মেয়র মালেক আমাকে হত্যার হুমকি দেন। এরপর তাদের নির্দেশে রেজাউল করিম শিকদার মন্টু, সুমন সিকদার, দিলীপ মাঝি, রাজ্জাক খান বাদশা, শাহজাহান খান তালুকদার, মৃধা মো. মনিরুজ্জামান, মাসুদ আহমেদ রানা, মজনু তালুকদার, মিজানুর রহমান তালুকদার মিলে আমাকে নির্দয়ভাবে পেটাতে থাকে। তাদের নির্যাতন শেষ হলে সাইদুল্লাহ লিটন, শেখ ফিরোজ আহমেদ, গোলাম মাওলা নকিব, আমিনুল ইসলাম মিরন, মতিউর রহমান, ইরতিজা হাসান রাজু, খায়রুল ইসলাম মিঠু, মোস্তাফিজুর রহমান বিপ্লবরা আমাকে চড়-থাপ্পড়, ঘুষি মারতে থাকে এবং লাঠি দিয়ে আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করতে থাকে। তারপরও আমি হুজুরের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা আগামীকাল তাদের কথামতো সাক্ষ্য দিতে রাজি না হলে আগামীকালই আমার জীবনের শেষ দিন বলে শাসিয়ে চলে যায়। আমি তাদের হাত থেকে ছাড়া পেয়া আত্মগোপনে চলে যাই। দীর্ঘদিন আমি এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে লুকিয়ে থাকি ।
পরবর্তীতে অনেক দিন পর সাঈদী হুজুরের ছেলে মাসুদ সাঈদী আমার সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করেন এবং আমার ভাই বিশাবালী হত্যার প্রকৃত ঘটনা জানতে চান। আমি তাকে প্রকৃত ঘটনা খুলে বলি। তখন মাসুদ সাঈদী জানতে চান, এই সত্য ঘটনা আমি ট্রাইব্যুনালে এসে বলতে রাজি আছি কি না? জবাবে আমি সম্মতি প্রকাশ করলে মাসুদ সাঈদী আমার ভাইয়ের হত্যার প্রকৃত ঘটনা ট্রাইব্যুনালে এসে বলার জন্য অনুরোধ করেন। আমি তার অনুরোধ গ্রহণ করি এবং সত্য ঘটনা তুলে ধরার জন্য সাঈদী হুজুরের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে রাজি হই।
সে অনুসারে আমি সাঈদী হুজুরের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে ২০১২ সালের ৩ নভেম্বর বিকালের দিকে ঢাকায় আসি এবং মাসুদ সাঈদীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে ৪ তারিখ ট্রাইব্যুনালে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম স্যারের কাছে নিয়ে আসেন। উনাকে আমি সব খুলে বলি। এরপর ৫ নভেম্বর সকালে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলামের অফিসে মাসুদ সাঈদী আমাকে নিয়ে যান। তখন অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম সাহেব আমাকে তার গাড়িতে করে ট্রাইব্যুনালের দিকে রওয়ানা দেন। তার গাড়িতে আরো দুজন আইনজীবী মনজুর আহমেদ আনসারী এবং হাসানুল বান্না সোহাগ ছিলেন, যাদের নাম আমি পরে জানতে পারি। আমার সামনের গাড়িতে মাসুদ সাঈদী ছিলেন এবং তার সঙ্গেও একজন আইনজীবী ছিলেন, যার নাম আবু বকর সিদ্দিক। এ সময় ট্রাইব্যুনালের গেটের বাইরে বিপুলসংখ্যক পুলিশ দেখতে পাই। ট্রাইব্যুনালের মূল গেটের কাছে আমাদের গাড়ি পৌঁছলে পুলিশ আমাদের গাড়ি আটকে দেয়। আটকে দেওয়ার পর সামনের গাড়ি থেকে নেমে মাসুদ সাঈদী পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। এর মধ্যে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাদা পোশাকে থাকা অনেক লোক এবং পুলিশ মিলে অ্যাডভোকেট মিজান স্যারের গাড়ি ঘিরে ফেলে। সেখানে আমাকে দেখে তারা বলেÑ‘শুয়োরের বাচ্চা, তোকেই তো আমরা খুঁজছি। নাম নিচে নাম।’ এ কথা বলেই একজন পুলিশ আমার কানের নিচে প্রচণ্ড জোরে থাপ্পড় মারে। এরপর শার্টের কলার ধরে আমাকে মারতে মারতে জোরপূর্বক গাড়ি থেকে নামিয়ে একটি সাদা রঙের পুলিশ পিকআপে তুলে দেয়। আমার সঙ্গে থাকা আইনজীবী এবং মাসুদ ভাই তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও পুলিশের আগ্রাসী ভূমিকার কারণে তারা আর আমার কাছেই আসতে পারেননি। গাড়িতে উঠিয়েই তারা আমার চোখ ও হাত বেঁধে ফেলে। ওই অবস্থায়ই তারা আমাকে অজানা একটি স্থানে নিয়ে যায়। সেটি ছিল একটি জানালাবিহীন অন্ধকার ঘর, যেখানে প্রায় দুই মাস আমাকে বন্দি রাখা হয় এবং খাদ্য ও আলো থেকে বঞ্চিত করে প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়।
দিনের পর দিন চলে বৈদ্যুতিক শক ও শারীরিক নির্যাতন
পরে আমাকে আরেকটি কক্ষে নেওয়া হয়, যেখানে ক্যামেরা ও আলো ছিল। সেখানে সাঈদী হুজুরের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করতে চাওয়া হয়। আমি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেই, আমার ভাইয়ের হত্যার সঙ্গে সাঈদী হুজুরের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, আমি প্রকৃত হত্যাকারীদের চিনি এবং তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু আমি তাদের কথামতো সাঈদী হুজুরের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় তারা আমাকে দিনের পর দিন বৈদ্যুতিক শক, শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে। আমার শরীরের এমন কোনো জায়াগা নেই, যেখানে তারা বৈদ্যুতিক শক দেয়নি (বিশেষ করে আমার গোপনাঙ্গে তারা বেশি শক দেয়)। এরপর তারা আমাকে কোটি টাকা ও একটি বাড়ি দেওয়ার প্রলোভনের মাধ্যমে আমার মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি তাতেও রাজি না হওয়ায় আমাকে প্রায় দুই মাস ওই গোপন জায়গায় আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। তাদের চরম নির্যাতনের মুখে আমি অসুস্থ ও অজ্ঞান হয়ে পড়লে আমাকে বিভিন্ন সময় হাসপাতালে নিয়ে জরুরিভিত্তিতে চিকিৎসা দেওয়া হতো। আমার জ্ঞান ফিরে এলে আবার তারা আমাকে ওই গোপন স্থানে নিয়ে আবারও পূর্বের ন্যায় শারীরিক নির্যাতন চালাত ।
চোখ বেঁধে তুলে দেওয়া হয় বিএসএফের হাতে
এভাবে নির্যাতন চালানোর মাঝে একদিন আমাকে চোখ বেঁধে একটি গাড়িতে তোলা হয় এবং দীর্ঘ যাত্রার পর যখন গাড়ি থামে তখন আমি বাথরুমে যাওয়ার কথা বললে তারা আমার চোখ খুলে দেয়। তখন দেখতে পাই আমাকে সীমান্ত এলাকায় আনা হয়েছে। সেখান থেকে বিজিবির সহায়তায় আমাকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশপরগনার স্বরুপনগর থানার বৈকারী বাজার সীমান্তে বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বিএসএফ আমাকে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই নির্মমভাবে মারধর করে, হাত বেঁধে নির্যাতন করে। পরে তারা আমাকে বশিরহাট নিয়ে যায়। বশিরহাট সাব-জেলে ২২ দিন রাখার পর সেখান থেকে দমদম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় এবং সেখানে আমাকে পাঁচ বছর আটক রাখে। পরে জানতে পারি দমদম কেন্দ্রীয় কারাগারে আমার থাকার বিষয়টি মাসুদ সাঈদী জানতে পারেন এবং আমার ছেলেকে ভারত পাঠিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হন। এরপর তারই উদ্যোগে এবং মানবাধিকার সংস্থা ও ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সহায়তায় আমি কারাগার থেকে মুক্ত হতে সক্ষম হই। কারাগারে থাকার সময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আমার সাঙ্গে কারাগারে সাক্ষাৎ করে এবং আমার নির্যাতনের বিবরণ নথিভুক্ত করে। দেশে ফিরে এলেও নিরাপত্তার কারণে আমি পিরোজপুরের নিজ গ্রামে যেতে পারিনি, বরং আত্মগোপনে নিজ জেলার বাইরে অবস্থান করি।
ট্রাইব্যুনালে অপহরণের কথা বলায় আদালত অবমাননার মামলা
আমি আমার ছেলেমেয়ের মাধ্যমে কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর জানতে পারি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে আমাকে অপহরণের পর আমার আইনজীবীরা আওয়ামী লীগের তৎকালীন ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে আমার অপহরণের বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন বিচারক, তৎকালীন চিফ প্রসিকিউটর, শাহবাগ থানার ওসি, রমনা জোনের ডিসি ও অন্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়ে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, আমাকে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণ থেকে অপহরণ করা হয়নি। অথচ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে অসংখ্য সিসি ক্যামেরা ছিল। বিশেষ করে আমাকে যেখান থেকে অপহরণ করা হয়েছিল, ওই গেটের সামনেই দুটি সিসি ক্যামেরা ছিল। ওই ক্যামেরা দুটিসহ স্থাপিত সিসি টিভি ক্যামেরায় পুরো বিষয়টি রেকর্ড হওয়ার কথা। আমার পক্ষের আইনজীবীদের দাবি সত্ত্বেও ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিম সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখতে বা দেখাতে অস্বীকৃতি জানান। সেটি না করে বিচারপতি নাসিম আমার বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করার দায়ে আমার আইনজীবীদের বিরুদ্ধে উল্টা আদালত অবমাননার অভিযোগ আনায়ন করেন ।
সুখরঞ্জন বালী তার অভিযোগে বলেন, আমি নিজ চোখে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার ভাইকে হত্যার ঘটনা দেখেছি। সেখানে সাঈদী হুজুর ছিলেন না। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়ায় এবং সত্য সাক্ষ্য দিতে ট্রাইব্যুনালে আসার কারণে আমাকে অপহরণ, গুম, নির্যাতন এবং প্রায় পাঁচ বছর ভারতে অবৈধভাবে কারাবন্দি রাখা হয়। তার বিরুদ্ধে করা মামলা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সাজানো। তাকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার, দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ রাখা এবং শেষ পর্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কারাগারে হত্যা করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের অধীন মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল। আমাকে অপহরণ, গুম, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন ও জোর করে ভারতে পাচারের ঘটনাÑসবই ছিল পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ। অপহরণ করে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে আমার মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে। আর এর সবই ছিল একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য। আমি এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় আমাকে করা অপহরণ, গুম এবং পাঁচ বছর অবৈধভাবে কারাবন্দি রাখাসহ আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সব অন্যায়ের বিচার চাই।
বাকি আসামি যারা
অভিযোগের অন্য আসামিরা হলেনÑঅ্যাডভোকেট আলাউদ্দিন, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর, পিরোজপুর দায়রা জজ আদালত; অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন, পিরোজপুর দায়রা জজ আদালত; হাবিবুর রহমান মালেক, সাবেক পৌর মেয়র, পিরোজপুর পৌরসভা; রেজাউল করিম শিকদার মন্টু, সাধারণ সম্পাদক, পিরোজপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ; আখতারুজ্জামান ফুলু, সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, পিরোজপুর জেলা; কানাই লাল বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক, পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগ; সুমন সিকদার, সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, পিরোজপুর জেলা; অ্যাডভোকেট দিলীপ মাঝি, সাধারণ সম্পাদক, কৃষক লীগ, পিরোজপুর জেলা; অ্যাডভোকেট রাজ্জাক খান বাদশা, সহসভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, পিরোজপুর জেলা; শাহজাহান খান তালুকদার, সহসভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, পিরোজপুর জেলা; মাসুদ আহমেদ রানা, সাবেক ভিপি, সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ, পিরোজপুর; শেখ ফিরোজ আহম্মেদ, দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, পিরোজপুর জেলা; গোলাম মাওলা নকীব, সম্পাদক, পিরোজপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থা, মিজানুর রহমান তালুকদার, পিতা মৃত আব্দুল মজিদ তালুকদার, সাং পশ্চিম পাড়েরহাট, ইন্দুরকানী; মতিউর রহমান, পিতা সুজাউদ্দিন হাওলাদার, গ্রাম চণ্ডীপুর, ইদুরকানী, পিরোজপুর প্রমুখ।
এ ঘটনায় সাক্ষী করা হয়েছে ব্যারিস্টার তানভীর আল আমিন, অ্যাডভোকেট মনজুর আহমেদ আনসারী, অ্যাডভোকেট আবু বকর সিদ্দিক, অ্যাডভোকেট হাসানুল হক বান্না সোহাগ, মাসুদ সাঈদী প্রমুখকে।
চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্য
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা অভিযোগ পেয়েছি। তদন্তে আমরা দেখব না যে কে কত বড় পদে ছিল, ক্ষমতাবান ইত্যাদি। এখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির নাম এসেছে। তদন্ত শেষে যদি তাদের সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য আসে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা সবাই জানি, বিগত ১৬ বছর গুমকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একটি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বাইরে থেকে মানুষকে গুম করার পাশাপাশি খোদ আদালত চত্বর থেকেও গুম করা হয়েছিল। তাকে দেশে ডিটেনশনে রাখার পাশাপাশি পরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। এ সবকিছুর ডকুমেন্ট রয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তার রিপোর্টের পর এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অভিযোগ দায়েরের সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী, তার আইনজীবী পারভেজ হোসেন প্রমুখ।
সাইদুর রহমান রুমী, ০১৯১৬৮৫৬৫১৬