
রাশিয়ার কাছ থেকে দুটি হেলিকপ্টার কিনেছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। হেলিকপ্টার দুটির দাম ৪০০ কোটি টাকা, যার ২৯৮ কোটি টাকা ইতিমধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন হেলিকপ্টার আনতে পারছে না বাংলাদেশ।
রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি মেনে হেলিকপ্টার আনলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপোড়েন তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। আবার রাশিয়ার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, বিষয়টি নিয়ে কূটনৈতিক সমাধানের জন্য গত ৩১ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়েছেন। রাশিয়ার সঙ্গে করা চুক্তির শর্তগুলো পর্যালোচনা করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়েছে।
রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি মেনে হেলিকপ্টার আনলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপোড়েন তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। আবার রাশিয়ার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কেনা হেলিকপ্টার দুটি এমআই-১৭১ এ ২ মডেলের। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জেএসসি রাশিয়ান হেলিকপ্টার্স। তারা গত ফেব্রুয়ারিতে একটি এবং এপ্রিলে দ্বিতীয়টির পাঠাতে কার্গো বিমান ভাড়া করেছিল। তবে প্রতিষ্ঠানটির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের নিষেধাজ্ঞা থাকায় হেলিকপ্টার আনার প্রক্রিয়া স্থগিত করে দেয় বাংলাদেশ সরকার।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে দুর্গম এলাকায় সন্ত্রাস দমনে পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে রাশিয়া থেকে দুটি হেলিকপ্টার কেনার সিদ্ধান্ত হয়। ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সদর দপ্তরে বাংলাদেশ পুলিশ ও রাশিয়ান হেলিকপ্টার্স নামের প্রতিষ্ঠানটির মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং রাশিয়ান প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক আন্দ্রে আই ভোগেনিস্কি স্মারকে সই করেন।
২০২১ সালের ৬ অক্টোবর অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি হেলিকপ্টার কেনার এ প্রস্তাব অনুমোদন দেয়। পরে ওই বছরের ১৯ নভেম্বর ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে তখন জানানো হয়েছিল, হেলিকপ্টার দুটি বেসামরিক প্রকৃতির এবং এর মাধ্যমে পুলিশের এয়ার উইং গঠিত হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাভুক্ত কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আনা বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য-সম্পর্ক অনেক গভীর। তিনি বলেন, বাংলাদেশ টিকফার (বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি) আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারে। দেশটি রাজি হলেই কেবল হেলিকপ্টার আনা উচিত। রাজি না হলে ঠিক হবে না।মামুন রশীদ, ব্যাংকার ও মুদ্রাবাজার বিশেষজ্ঞ
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পরও চুক্তি
২০২১ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। অথচ একই বছরের নভেম্বরে নিষেধাজ্ঞাভুক্ত জেএসসি রাশিয়ান হেলিকপ্টার্সের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার চুক্তি সই করে। প্রশ্ন উঠেছে, নিষেধাজ্ঞার কথা জানার পরও কেন ২৯৮ কোটি টাকা পরিশোধ করা হলো।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বিগত সরকারের করা এই চুক্তির কারণে এখন বিপাকে আছে বর্তমান সরকার। তারা হেলিকপ্টার দুটি আনার উপায় খুঁজছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পুলিশ অনুবিভাগ) আতাউর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, কূটনৈতিক উপায়ে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করে হেলিকপ্টার দুটি আনা যায় কি না, সে পথ খোঁজা হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে দুর্গম এলাকায় সন্ত্রাস দমনে পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে রাশিয়া থেকে দুটি হেলিকপ্টার কেনার সিদ্ধান্ত হয়।
আর্থিক ক্ষতি বাড়তে পারে
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, হেলিকপ্টার দুটি এখন রাশিয়ার ওয়্যারহাউসে (গুদাম) রাখা আছে। রক্ষণাবেক্ষণে খরচও হচ্ছে।
চুক্তিপত্র অনুযায়ী হেলিকপ্টার না নিলে আর্থিক ক্ষতি আরও বাড়তে পারে। দুই পক্ষের মধ্যে করা চুক্তির একটি ধারায় উল্লেখ আছে, চুক্তি ভাঙলে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ব্যয় করা পুরো অর্থ দাবি করতে পারবে। বিরোধ দেখা দিলে তা নিষ্পত্তি হবে আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন সেন্টারে (এসআইএসি)। পুলিশ সদর দপ্তরের আশঙ্কা, বাংলাদেশ হেলিকপ্টার না নিলে প্রতিষ্ঠানটি মামলা করতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর চেষ্টা করা হোক। যুক্তি হিসেবে হেলিকপ্টার দুটি যে বেসামরিক প্রকৃতির এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কাজে লাগবে, তা উল্লেখ করা হয়েছে। হেলিকপ্টার দুটি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের জন্য। অন্য কাউকে দেওয়ার সুযোগও নেই।
অবশ্য গত জুনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের মতামতে জানিয়েছিল, বাংলাদেশ সরকার হেলিকপ্টার গ্রহণের দিকে এগোলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
ব্যাংকার ও মুদ্রাবাজার বিশেষজ্ঞ মামুন রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাভুক্ত কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আনা বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য-সম্পর্ক অনেক গভীর। তিনি বলেন, বাংলাদেশ টিকফার (বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি) আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারে। দেশটি রাজি হলেই কেবল হেলিকপ্টার আনা উচিত। রাজি না হলে ঠিক হবে না।
সরকার চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রেয়াত চেয়ে আবেদন করতে পারে। হেলিকপ্টার দুটি বেসামরিক কাজের জন্য আনা হচ্ছে এবং হেলিকপ্টার না আনলে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়বে—এমন বাস্তবতা তুলে ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সহযোগিতা চাইতে পারে সরকার। যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই বাস্তবতা বুঝে অনুমতি দিতে পারে।এম হুমায়ুন কবির, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
‘যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আবেদন করা যেতে পারে’
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে রাশিয়ার কাছ থেকে বেশ কিছু সমরাস্ত্র কেনা হয়েছিল। ২০১৩ সালে সামরিক সরঞ্জাম কেনার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়। এ ছাড়া রাশিয়ার ঋণ ও কারিগরি সহায়তায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ। এটি দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প এবং এই প্রকল্পের অর্থ লেনদেনেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে রয়েছে বাংলাদেশ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, রূপপুরে রাশিয়ার ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশের পরিশোধ করা অর্থ এখন বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি বিশেষ হিসাব খুলে রাখা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে অর্থ রাশিয়ায় পাঠানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক একবার অর্থ পরিশোধের চেষ্টা করেছিল। তবে ঝুঁকি মনে করে আর পরিশোধ করেনি।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, সরকার চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রেয়াত চেয়ে আবেদন করতে পারে। হেলিকপ্টার দুটি বেসামরিক কাজের জন্য আনা হচ্ছে এবং হেলিকপ্টার না আনলে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়বে—এমন বাস্তবতা তুলে ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সহযোগিতা চাইতে পারে সরকার। যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই বাস্তবতা বুঝে অনুমতি দিতে পারে।