Image description
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ‘ড. ফ্রিডটজফ নানসেন’ জাহাজে ২১ আগস্ট থেকে ২১ সেপ্টেম্বর গবেষণা জরিপ : মিশনে যাচ্ছেন দেশ-বিদেশের ২৬ বিজ্ঞানী মৎস্যসম্পদের বাঁচার পরিবেশ, ‘ন্যূনতম অক্সিজেন জোন’, জেলিফিশসহ অযাচিত প্রাণীর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, প্লাস্টিক দূষণে জীববৈচিত্র্যে হুমকি শনাক্ত হবে

কেমন আছে বঙ্গোপসাগরের মাছেরা? জটিল এ বিষয়ে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর পেতে আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে ৩২ দিনব্যাপী মিশনে সমুদ্রে ছুটছেন বাংলাদেশের ১৩ জনসহ বিভিন্ন দেশের ২৬ জন সামুদ্রিক পরিবেশ ও মৎস্যবিজ্ঞানী-গবেষক। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহায়তায় নরওয়ের সর্বাাধুনিক প্রযুক্তির গবেষণা জাহাজ ‘ড. ফ্রিডটজফ নানসেন’ যোগে ২১ আগস্ট থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিবিড় জরিপ ও গবেষণা পরিচালিত হবে। ‘ড. ফ্রিডটজফ নানসেন’ জরিপ কার্যক্রম এবার হচ্ছে ৫ বছর বিরতির পর। বঙ্গোপসাগরে মৎস্যসম্পদ জরিপ প্রায় একশ’ বছরের ধারাবাহিকতা। আন্তর্জাতিকমানের এ ধরনের জরিপ ও অনুসন্ধান গবেষণা-জাহাজের নামানুসারেই পরিচিত হয়।

জরিপ ও গবেষণা কার্যক্রম সম্পর্কে গবেষকদলের অন্যতম বিজ্ঞানী চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের বিশিষ্ট সমুদ্রবিজ্ঞানী প্রফেসর সাইদুর রহমান চৌধুরী গতকাল মঙ্গলবার ইনকিলাবকে জানান, সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ ও প্রাণ-প্রকৃতির সম্ভাব্য অবস্থান, স্থিতি, প্রজনন, বিচরণ পরিবেশ, হুমকিসমূহ ইত্যাদি সব বিষয়ে নিবিড় জরিপ পরিচালনা করা হবে। দেশের সমুদ্র সম্পদের উন্নয়নে ও অর্থনৈতিক সদ্ব্যবহারে এটি আগামীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। তিনি জানান, বাংলাদেশের গবেষকদল আজ বুধবার কলম্বো যাচ্ছেন। সেখান থেকে আরোহন করবেন গবেষণা জাহাজে।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কি.মি. পানিসীমায় ৫৭৬ প্রজাতির মৎস্য ও ৩৬ প্রজাতির চিংড়িসহ অঢেল এবং বিচিত্র সম্পদরাশিতে ভরপুর। এবার ‘ড. ফ্রিডটজফ নানসেন’ জরিপে সামুদ্রিক জগতে মৎস্যসম্পদেও সার্বিকভাবে বাঁচার পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, সমুদ্রে ‘শূন্য বা ন্যূনতম অক্সিজেন জোন’-এর অবস্থান শনাক্তকরণ ও করণীয় নির্ধারণ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও এসিডের হার, মহাসাগরের তাপমাত্রা, জেলিফিশসহ অযাচিত অন্যান্য প্রাণীকুলের সাম্প্রতিক সময়ে অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সামুদ্রিক অর্থকরী মৎস্যসম্পদ এবং পরিবেশের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া, সমুদ্রজুড়ে রাসায়নিক ও প্লাস্টিক দূষণের ব্যাপকতার কারণে জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক হুমকি ইত্যাদি বিষয়গুলো গবেষাণায় বেরিয়ে আসবে। জেলিফিশের রহস্যজনক বৃদ্ধিতে মৎস্যসম্পদ আহরণে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে জেলিফিশসহ অন্যান্য অযাচিত প্রজাতির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সম্পর্কে শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্র উন্মোচিত হবে।

‘ড. ফ্রিডটজফ নানসেন’ গবেষণা জরিপে উপকূলীয় ২০ থেকে ২০০ মিটার পানির গভীরতায় বিচরণকারী ছোট আকারের পেলাজিক মৎস্যসম্পদের মজুদ নিরুপন করা যাবে। এর পাশাপাশি দেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক জোনে (ইইজেড) ২২শ’ মিটার গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত পানিসীমায় ইকোসিস্টেম গবেষণা এবং পানির প্রবাহের অবস্থা, উদ্ভিদ ও প্রাণিকণার উপস্থিতি, পেলাজিক ও মেসোপেলাজিক মাছের প্রাচুর্যতা, প্লাস্টিক দূষণ ও খাদ্য নিরাপত্তা এবং মাছের পুষ্টিগুণ নিয়েও জরিপ ও গবেষণা হতে যাচ্ছে। ‘ড. ফ্রিডটজফ নানসেন’ ভারত মহাসাগরের পাশাপাশি বাংলাদেশের অনুরোধের প্রেক্ষিতে এফএও’র অনুমতিতে এবার ২০২৫ সালের জরিপের সময়সূচিতে ২১ আগস্ট থেকে ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। গবেষকগণ আশা করছেন, এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে টেকসই সমুদ্রসম্পদ আহরণের সর্বোচ্চ সহনীয়-সীমা নির্ধারণ করা হবে। এর পাশাপাশি গভীর ও আন্তর্জাতিক সমুদ্র অঞ্চলে বাণিজ্যিক মৎস্যসম্পদের অনুসন্ধান ও আহরণের ক্ষেত্রে বিরাট সম্ভাবনার দ্বার খুলবে।

এদিকে সমুদ্রতলে শূন্য বা জিরো অক্সিজেন জোন সৃষ্টি হওয়ায় সাগরের বিরাট অংশে মাছসহ প্রাণি ও প্রকৃতির প্রজনন, বিচরণ ও বাঁচার পরিবেশ প্রায় বিরান হতে চলেছে। যা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে সমুদ্রতলে চোখের আড়ালে একটি ভয়ানক সঙ্কটে রূপ নিচ্ছে। সেই সঙ্গে ক্রমাগত বিস্তার লাভ করছে সমুদ্র পরিবেশে ও উপকূলে পলিথিন-স্তর আর প্লাস্টিকের পাহাড়। প্লাস্টিক বোতল, বক্স, শপিংব্যাগ থেকে শুরু করে নানান উপকরণ হিসেবে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে পলিথিন-প্লাস্টিক। চারদিকে নীরব ঘাতকের মতো গ্রাস করছে। পলিথিন-প্লাস্টিক নিছক পরিবেশ দূষণেই সীমিত নেই; বরং স্বাস্থ্যঘাতী তথা প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভূপৃষ্ঠ-মাটি-পানি এমকি সমুদ্রে সর্বত্রই সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে প্লাস্টিক ও পলিথিন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে দৈনিক হাজারো টন ফেলা হচ্ছে প্লাস্টিক আর পলিথিনের বস্তু। সেই প্লাস্টিক-পলিথিনের বর্জ্য কণা (মাইক্রোপ্লাস্টিক) খাদ্যের সাথে গিলছে হরেক জাতের সামুদ্রিক মাছসহ প্রাণিকুল। খাদ্যচক্রে মাছের সঙ্গে সহজেই ঢুকে যাচ্ছে মানুষের পেটে। যা ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক রোগ-ব্যাধির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সমুদ্রে প্লাস্টিক-পলিথিনের ব্যাপক ছড়াছড়ি। এর ফলে মাছের শরীর হয়ে ঘুরেফিরে শেষ গন্তব্য হিসেবে মানুষের শরীরেই তা ঢুকছে।

দেশের নদ-নদী, খাল-বিল-হাওড়, পুকুর-জলাশয়েরও একই চিত্র। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক অঙ্গসংস্থার তথ্য মতে, বার্ষিক ৮০ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি পরিমাণে প্লাস্টিক-পলিথিন দ্রব্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। বাস্তবে এর পরিমাণ আরো বেশিই ধরা হয়। এরমধ্যে বঙ্গোপসাগরে কী পরিমাণে প্লাস্টিক-পলিথিন নিক্ষিপ্ত হচ্ছে তার সঠিক তথ্য নেই।

এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সাগর-মহাসাগরে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণই বেশি হবে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। প্লাস্টিক-পলিথিনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কমপক্ষে ৬শ’ প্রাণী। এ ক্ষেত্রে ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ এবং দেশের সমুদ্র অঞ্চল। কেননা এ অবস্থায় মাছসহ সামুদ্রিক প্রাণিকুলের গলায় ও পেটে প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্য আটকে মারা যাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে বংশ বিস্তার। একইভাবে সী-গালসহ সমুদ্রে বিচরণশীল পাখীরাও নির্বংশ হচ্ছে।

এর পরিণতিতে সামুদ্রিক মাছসহ প্রাণিকুল, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। পৃথিবীর বিভিন্ন সাগর-উপসাগরের মতো বঙ্গোপসাগর মাছশূণ্য হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা আর্থ ডে নেটওয়ার্ক-এর প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের শীর্ষ প্লাস্টিক-পলিথিন দূষণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। অবাধে এমনকি অপ্রয়োজনেও ব্যবহার করা হচ্ছে প্লাস্টিক-পলিথিন সামগ্রী। অথচ কেউই ভাবছে না ঘুরেফিরে তা মানুষেরই পেটে যাচ্ছে। পরিবেশ, জনস্বাস্থ্যহানি ছাড়াও ডেকে আনছে সাগরে ও নদ-নদী-জলাশয়ে মাছের স্বাভাবিক স্থিতি বা মজুদ ও বংশ বিস্তারে বিপর্যয়।

চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট অব ফিশারিজের সাবেক পরিচালক বিশিষ্ট সমুদ্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. হোসেন জামাল ইনকিলাবকে বলেন, সমুদ্রে ক্রমাগত জমা হওয়া প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্য দূষণ সারাবিশে^ আলোচিত বিপদ। সমুদ্রে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক-পলিথিন সামগ্রী প্রথমে বড় বড় টুকরা হিসেবে ভাসে বা পানির মধ্যে ঝুলে থাকে। এরপর সামুদ্রিক আবহাওয়ায় ভেঙে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা (মাইক্রোপ্লাস্টিক) হিসেবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এগুলো আরো ছোট হতে হতে প্রসার ঘটতে থাকে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, মাছসহ সামুদ্রিক প্রাণিকুলের খাদ্যচক্রে মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো পেটে পাকস্থলীতে ঢুকে যায়। প্লাস্টিক-পলিথিন বড় সাইজ হলে গলায় আটকে মারা যায়। ক্ষুদ্র হলে মাছেরা গিলে ফেলে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো, আমরা যখন সেই মাছ বা সামুদ্রিক প্রাণীগুলো খাই, তখন মানবদেহে চলে আসছে।

প্লাস্টিক-পলিথিনের টুকরোগুলো সামুদ্রিক আবহাওয়া, স্রোত ও ঘূর্ণিতে ক্রমাগত ভেঙেচুরে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে। যা সামুদ্রিক মাছসহ প্রাণিকুলের সাথে মানুষের জন্যও বিপদ ডেকে আনছে। সমুদ্রের পানির প্রথম, দ্বিতীয়সহ সব লেয়ারেই (স্তরে) প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্যরে দূষণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এতে করে সামুদ্রিক মাছ, পাখিসহ প্রাণিকুলের জন্য প্লাস্টিক-পলিথিন বড় ধরনের হুমকি।