Image description

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জনবল নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ নতুন না হলেও এবার রাজশাহীর তানোরের একটি কলেজে ঘটেছে নজিরবিহীন জালিয়াতির ঘটনা। কলেজের দুজন সাবেক অধ্যক্ষ এবং গভর্নিং বডির সদস্যদের স্বাক্ষর জাল করে একজনকে ২৩ বছর আগের তারিখে এবং আরেকজনকে সাম্প্রতিক সময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি কোষাগার  থেকে বেতন-ভাতা আত্মসাতের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। 

এ চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটেছে তানোর উপজেলার লালপুর মডেল কলেজে। 

কলেজের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনসুর রহমানের বিরুদ্ধে এমন জালিয়াতির অভিযোগ এনে গত ১২ আগস্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম। অভিযোগটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন ইউএনও। 

অভিযোগনামা ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ সফিকুল ইসলামের মৃত্যুর পর বিভিন্ন সময়ে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন একাধিক শিক্ষক। সর্বশেষ অধ্যক্ষ আব্দুল মতিন ২০২৪ সালের নভেম্বর অবসরে গেলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পান  মনসুর রহমান। অভিযোগ, দায়িত্ব পেয়েই তিনি পুরোনো নথি ঘেঁটে জালিয়াতির ছক আঁকেন। সে অনুযায়ী গায়েবি ফাইল তৈরি করে গোপনে একজন প্রদর্শক ও একজন কর্মচারী নিয়োগের কাজ করেন।  

অভিযোগে জানা গেছে, পূর্ববর্তী দুজন অধ্যক্ষ ও গভর্নিং বডির সদস্যদের স্বাক্ষর হুবহু নকল করে দুজনকে নিয়োগের ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করেন বর্তমান অধ্যক্ষ মনসুর রহমান। এদের মধ্যে আবুল কালাম আজাদ নামের একজনকে জীববিদ্যা বিষয়ের প্রদর্শক পদে নিয়োগ দেখানো হয়; যার যোগদানের তারিখ উল্লেখ করা হয় ২২ সেপ্টেম্বর ২০০২। সেই হিসাবে প্রায় ২৩ বছর আগের একটি তারিখে তাকে নিয়োগ দেখিয়ে নিয়মিত বেতন-ভাতা চালু করার চেষ্টা করা হয়। অন্যদিকে, মতিউর রহমান নামের আরেকজনকে অফিস সহায়ক পদে নিয়োগ দেখানো হয় ২০২৪ সালে। 

এই নিয়োগ দুটি এতদিন গোপন থাকলেও গত মে মাসের সরকারি বেতনের জন্য পাঠানো ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) তালিকায় এই দুজনের নাম অন্তর্ভুক্ত হলে বিষয়টি প্রথম কলেজ সংশ্লিষ্টদের নজরে আসে। এরপরই কলেজের অন্যান্য শিক্ষক-কর্মচারী ও এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। তাদের দাবি, এই দুজনকে কোনো দিন কলেজের যেতে আসতে দেখেননি তারা। তাদের নিয়োগের বিষয়ে কলেজের শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীরা কিছুই জানেন না। বিপুল অংকের টাকা নিয়ে অধ্যক্ষ এই জালিয়াতির কাজটি অত্যন্ত কৌশলে সম্পন্ন করেন বলে এলাকাবাসী জানান।   

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, মনসুর রহমান ২০১০ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত তানোরের লালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক (বিপিএড) পদে নিয়মিত চাকরি করেছেন। অথচ একই সময়ে তিনি ২০০৩ সাল থেকে লালপুর মডেল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং সরকারি বেতন-ভাতাদি গ্রহণ করেছেন; যা সরকারি চাকরি বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ১৯৯৮ সালে তিনি পার্শ্ববর্তী মুন্ডমালা মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। সে সময় বিভিন্ন আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেন।  তার বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতিসহ একাধিক মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বলেও দাবি করেছেন অভিযোগকারী।

এদিকে এই ঘটনায় শুধু কলেজের অভ্যন্তরীণ পরিবেশই নয়, এলাকার শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগকারী শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এটি কেবল একটি আর্থিক দুর্নীতি নয়, এটি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আত্মার সঙ্গে প্রতারণা করা। যে অধ্যক্ষের নিজের বিরুদ্ধেই এত অভিযোগ, তিনি কিভাবে একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন।  আমরা চাই, কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে প্রশাসন একটি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে তদন্ত করুক। তদন্তে কলেজের উপস্থিতির খাতা, রেজ্যুলেশন বই এবং ডিআইএ (পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর)-এর পুরোনো নথি যাচাই করলেই অভিনব এই জালিয়াতির রহস্য বেরিয়ে আসবে।

এলাকার একাধিক অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের সন্তানদের একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে আমরা শঙ্কিত। এমন ঘটনা পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে কলুষিত করেছে। আমরা অধ্যক্ষের জালিয়াতির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করছি। তারা আরও বলেন, অভিনব এই নিয়োগ জালিয়াতির সঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কলেজ শাখার কতিপয় কর্মকর্তাও জড়িত। নিয়োগের পূর্ণাঙ্গ নথিপত্র ছাড়া তারা কিভাবে এই দুজনের বেতনভাতার সুপারিশ করেছে তাও খতিয়ে দেখা দরকার। 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে লালপুর মডেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. মনসুর রহমান বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে করা সব অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট’। তিনি আরও বলেন, ‘আগে নিয়োগ হলে তখন যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা ভালো বলতে পারবেন। এসব বিষয়ে আমি জানি না। আমি এই নিয়োগের সঙ্গে জড়িত নই’।  

এদিকে, তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় অভিযোগটি গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে ইউএনও বলেন, ‘আমরা একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। শিগগিরই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনার সত্যতা যাচাই করা হবে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে এবং যারা এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’।