
পাঁচ বছরে খরচ হয়েছে হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু প্রকল্পের মূল লক্ষ্য বাস্তবায়ন হয়নি। যন্ত্রপাতি অচল, নিয়োগ হয়নি জনবল, অনেক জেলায় আইসিইউ ইউনিট বন্ধ। ৫৬৪ কোটি টাকার অডিট আপত্তিরও মিলছে না জবাব।
জেলা পর্যায়ে আইসিইউ স্থাপন ও কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় নেওয়া ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্প বাস্তবায়নে এমন বিপর্যয়কর চিত্র উঠে এসেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে।
প্রকল্পের আওতায় বিশ্বব্যাংকের টাকা খরচের সময়সীমা ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হয়। কিন্তু এর আগে পূর্ত কাজ হয়নি। যে কারণে যন্ত্রপাতি কেনা হয়নি। নির্মাণ দেরিতে হয়েছে।- প্রকল্প পরিচালক ড. সাইফুল ইসলাম
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ৫০টি জেলায় প্রতিটি ১০ শয্যার ৫০০ আইসিইউ স্থাপনের লক্ষ্য ছিল প্রকল্পের আওতায়। চালু হয়েছে মাত্র ১৩টি জেলায়। ১৬টি শিশু-আইসিইউ (পেডিয়াট্রিক) এবং ১৫টি মাতৃ-আইসিইউ (অবস্টেট্রিক)—কোনো কাজই শুরু হয়নি। ৫০টি জেলায় ২০ শয্যার এক হাজার আইসোলেশন ইউনিট নির্মাণের অগ্রগতি শূন্য। অথচ গত পাঁচ বছরে কাজগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ৫৬৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকার হিসাব দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। এমনকি ৭৬টি অডিট আপত্তিও দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রকল্প অফিস মাত্র আটটি অডিট আপত্তির জবাব দিয়েছে, বাকিগুলোর কোনো খবর নেই।
প্রকল্পটি নিয়ে নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছে আইএমইডি। মূলত যেসব বিভাগ ও জেলায় মেডিকেল কলেজ আছে সেসব জেলা বাদ দিয়ে বাকি ৫০টি জেলা হাসপাতাল নির্বাচন করা হয়।
যথাসময়ে আইসিইউ নির্মাণ না করা প্রসঙ্গে প্রকল্পের পরিচালক ড. সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় বিশ্বব্যাংকের টাকা খরচের সময়সীমা ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হয়। কিন্তু এর আগে পূর্ত কাজ হয়নি। যে কারণে যন্ত্রপাতি কেনা হয়নি। নির্মাণ দেরিতে হয়েছে।’
আমরা প্রকল্পগুলো তদারকি করছি। কিছু প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ ও প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছি। তার মধ্যে অন্যতম ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্প। প্রতিবেদনটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও প্রকল্প পরিচালককে দেওয়া হয়েছে।- আইএমইডি সচিব মো. কামাল উদ্দিন
যেগুলো চালু হয়েছে সেগুলো বন্ধ কেন? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পরে সংশ্লিষ্টদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন তারা পরিচালনা করবে। যেসব কাজ বাকি আছে, সেগুলো স্বাস্থ্যের অপারেশন প্ল্যানের (ওপি) মাধ্যমে করা হবে। সেই প্রকল্পের আওতায় বাকি সব আইসিইউ নির্মাণ করা হবে।’
৫৬৪ কোটি টাকার অডিট আপত্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এগুলো অডিট আপত্তি সঠিক না। অনেক ক্ষেত্রে অনেক ডুপ্লিকেট আছে।’
আইএমইডি জানায়, প্রকল্পের অন্যতম প্রধান কাজ আইসিইউ স্থাপন/অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্রগতি অনেকটা হতাশাব্যঞ্জক। পণ্য ও সেবা সংগ্রহের কাজ প্রকল্প অফিসের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। কিন্তু পূর্ত কাজ শুরু করতে অস্বাভাবিক দেরি হওয়ার কারণে বিলম্বিত হচ্ছে আইসিইউ স্থাপনের কাজ। এমনকি যেসব জেলায় আইসিইউ আংশিক চালু হয়েছে, সেগুলোতেও রয়েছে মানবসম্পদ সংকট, যন্ত্রপাতির ঘাটতি এবং পরিকাঠামোগত অসংগতি।
কুমিল্লা, যশোর, টাঙ্গাইল, বরিশালসহ কয়েকটি জেলায় আইসিইউ ইউনিট চালু হলেও সেখানে নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, নার্স, যন্ত্রপাতি ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা।
আইসিইউর চাহিদা সবখানে, সংখ্যা অপ্রতুল
ঢাকার বাইরে সাধারণ মানুষ চিকিৎসার ক্ষেত্রে সব সময় পিছিয়ে থাকে। করোনা মহামারিতে তা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। একজন রোগীর জন্য অক্সিজেন বা আইসিইউর প্রয়োজন হলেও তাকে পাঠাতে হতো ঢাকায় বা বিভাগীয় শহরে। এই দুর্ভোগ দূর করতেই জেলা পর্যায়ে আইসিইউ স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এ লক্ষ্যই সবচেয়ে উপেক্ষিত।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, করোনা মহামারি থেকে দেশবাসীকে রক্ষার্থে অনেক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় পরিস্থিতি মোকাবিলা ও পরবর্তীসময়ে বিশ্বব্যাংক-এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হলেও কাজের বিপরীতে লুটপাট-দুর্নীতি বেশি হয়েছে। আইএমইডি প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
কোভিড মহামারির সময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় তৎকালীন সরকার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) মাধ্যমে ছয় হাজার ৩৮৭ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়। মূল লক্ষ্য ছিল, দেশে করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি ভবিষ্যতের যে কোনো মহামারির জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামোগত সক্ষমতা গড়ে তোলা। এপ্রিল ২০২০ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পের মেয়াদ ৩০ জুন ২০২৫ নাগাদ। ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৭৬ শতাংশ। কাজ যথাসময়ে শেষ না হওয়ায় মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনাধীন।
বহুবিধ সমস্যা
প্রকল্পের বিষয়ে আইএমইডির খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব সরঞ্জাম কেনা হয়েছে, এর মধ্যে অনেক আছে যা সঠিক মডেল নয়, নেই প্রমাণিত কার্যকারিতা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরবরাহকারীরা ছিল অযোগ্য। ফলে চাহিদামতো সরঞ্জাম এলেও তা ব্যবহারযোগ্য নয়। যশোর জেনারেল হাসপাতালে আইসিইউ বসানো হয়েছে চতুর্থ তলায়। কিন্তু লিফট ঠিকমতো কাজ না করায় সেখানকার রোগীরা ইউনিটে যেতে পারছে না।
টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ ২০২১ সালে চালু হলেও জনবল সংকটে ২০২৪ সালে তা বন্ধ হয়ে গেছে। আইসিইউর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন বা ভবন নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল গণপূর্ত অধিদপ্তরের (পিডব্লিউডি)। কিন্তু আইএমইডির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, পিডব্লিউডি সময়মতো কাজ শুরুই করতে পারেনি। অনেক জায়গায় এখনো সিভিল ওয়ার্ক হয়নি। ফলে যন্ত্রপাতি এলেও বসানো যায়নি। প্রকল্পের আওতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জরুরিভিত্তিতে অন্তত ৫০০ জন নার্স, ২০০ জন চিকিৎসক ও সমসংখ্যক টেকনিশিয়ান নিয়োগের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু পাঁচ বছরেও তা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে আইএমইডি সচিব মো. কামাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা প্রকল্পগুলো তদারকি করছি। কিছু প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ ও প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছি। তার মধ্যে অন্যতম ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্প। প্রতিবেদনটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও প্রকল্প পরিচালককে দেওয়া হয়েছে। যে প্রকল্প বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। আর যেগুলো বাস্তবায়নযোগ্য না সেসব প্রকল্প বাদ দেওয়ার সুপারিশ করছি।’