Image description
হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে চারজনের সাক্ষ্য, উপস্থিত সবাইকে কাঁদালেন শাহিনা * মায়ের ফোনের জবাবে ছেলে-‘আমার সামনে চারটি লাশ, একজন আহতকে বুকে আগলে বসে আছি, এখন কথা বলতে পারছি না’

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন আশুলিয়ায় শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের মা শাহিনা বেগম। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আমার একমাত্র ছেলে সাজ্জাদ হোসেন সজল আশুলিয়া বাইপাইল এলাকায় দিনভর আন্দোলন করে। আমি তাকে খোঁজাখুঁজি করে কোথাও পাইনি। পরদিন ৬ আগস্ট ভোরে আশুলিয়া থানার সামনে আমি যাই। সেখানে পুলিশের পিকআপ ভ্যানে কয়েকটি পোড়া লাশ দেখতে পাই। তখন উপস্থিত লোকজন লাশের ছবি ও ভিডিও করছিল। আমি ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে প্রথমে মোবাইলে একটি ছবি তুলি। সেখানে একটি লাশ এমনভাবে পুড়ে ছিল যেন পায়ের মোটা হাড়টা বের হয়ে গিয়েছিল। সেই হাড়ের সঙ্গে একটি জুতা পোড়া অবস্থায় ঝুলছিল। সেটা দেখেই আমি বুঝতে পারি, এটা আমার ছেলে সাজ্জাদের জুতা।’ ছেলেকে এমন নির্মম হত্যার বিবরণ দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন শাহিনা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেসহ সারা দেশে দুই হাজার মানুষ হত্যাকারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সহযোগীরা এসব ঘটনার জন্য দায়ী।’ এ দিন সাজ্জাদের কবরের পাশে তার মেয়ের কান্নার একটি ভিডিও ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শন করা হয়। এছাড়া ঘটনার আলামত হিসাবে দুটি ছবি ট্রাইব্যুনালে জমা দেন সাক্ষী।

বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ রোববার এ জবানবন্দি দেন শাহিনা বেগম। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। শাহিনা বেগম ছাড়াও আরও তিন সাক্ষী-সবজি বিক্রেতা আবদুস সামাদ, জব্দ তালিকার সাক্ষী মিজান মিয়া ও খুলনার আহত শিক্ষার্থী নাইম শিকদার এদিন সাক্ষ্য দেন। পরে তাদের জেরা করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। আদালতে প্রসিকিউশনের পক্ষে মো. মিজানুল ইসলাম, বিএম সুলতান মাহমুদ, গাজী এমএইচ তামিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যান্য প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন।

প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ অক্টোবরের মধ্যে শেষ হতে পারে। তিনি বলেন, এ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা ছাড়া সাক্ষীদের (মেটেরিয়াল উইটনেস) সাক্ষ্যগ্রহণ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই শেষ করা যাবে বলে আমরা আশা করছি। খুব বেশি হলে পরের মাস, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে যেতে পারে।’

প্রসিকিউশন জানায়, ৮১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪ দিনে ৯ জনের সাক্ষ্য নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। অন্য সাক্ষীদের মধ্যে রয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা ও জাতীয় দৈনিকের এক সম্পাদক।

জুলাই আন্দোলনে আহত সাক্ষী নাঈম শিকদার আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে জানান-কিডনি, লিভার ও স্পাইনাল কার্ডসহ তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় এখনো পাঁচ শতাধিক স্পি­ন্টার নিয়ে তিনি ধুঁকছেন। আরেক সাক্ষী আবদুস সামাদ তার মাথার পেছনে গুলি লাগা এবং চিকিৎসায় অবহেলার বর্ণনা তুলে ধরেন।

১০ জুলাই শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

রোববার সকালে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ। কয়েকদিন আগে তিনি দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেছিলেন। তিন আসামির মধ্যে একমাত্র তিনি কারাগারে আটক। বাকি দুজনকে পলাতক দেখিয়ে এ মামলার কার্যক্রম চলছে। রামপুরা, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ীর তিনটি মামলায় ১৫ জন আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এসব মামলায় প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ সময় আবেদন করলে তদন্ত রিপোর্ট দাখিলের সময় পিছিয়ে দেন ট্রাইব্যুনাল।

১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আন্দোলন দমনে ১৪০০ জন আন্দোলনকারীকে হত্যার নির্দেশ প্রদান, উসকানি, প্ররোচনাসহ ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসেবলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ’র পাঁচ অভিযোগে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

গত বছরের ৫ আগস্ট বেলা ৩টার দিকে আশুলিয়া থানার সামনে পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর বাইরে আরও একজন গুলিতে গুরুতর আহত হন। একজনকে জীবিত ও পাঁচজনকে মৃত অবস্থায় প্রথমে একটি ভ্যানে তোলা হয়। সেখান থেকে পুলিশের একটি গাড়িতে তোলে পুলিশ। পুলিশের গাড়িতে এই ছয়জনকে (যার মধ্যে একজন জীবিত) আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় পুলিশ। এ সময় যারা শহীদ হয়েছেন, তারা হলেন-সাজ্জাদ হোসেন (সজল), আস সাবুর, তানজীল মাহমুদ সুজয়, বায়েজিদ বুসতামি, আবুল হোসেন ও একজন অজ্ঞাত।

শহীদ সজলের মায়ের জবানবন্দি : সাজ্জাদ হোসেন সজলের মা ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরে বলেন, ‘আমি আশুলিয়ায় নারী ও শিশু হাসপাতালে পরিছন্নতাকর্মী হিসাবে কাজ করতাম। আমার ছেলে ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় বাইপাইল এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেয়। সেদিন হাসপাতালে অনবরত গুলিবিদ্ধ রোগী আসছিল। তখন আমি বারবার ছেলেকে ফোন করে বলি, বাবা তুমি বাসায় ফিরে আসো। হাসপাতালে অনেক গুলিবিদ্ধ আহত রোগী আসতেছে, তোমার আন্দোলনে থাকার দরকার নেই। তখন সে আমাকে বলে, তুমি এমন স্বার্থপর কেন আম্মু? আমি এখন বাসায় যেতে পারব না। আমার সামনে চার চারটা লাশ এবং আমি একজন আহতকে ধরে বসে আছি।’

জবানবন্দিতে শাহিনা বেগম বলেন, ‘সেদিন বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে আমাদের হাসপাতালে দুটি মৃতদেহ আসে। অনেক আহত রোগী আসে। আমি তখন আমার ছেলেকে আবার ফোন করে বাসায় চলে যেতে বলি। কিন্তু সে বাসায় ফিরে আসেনি। সে আমাকে বলে, মা আমি যদি মারা যাই, তাহলে হাজার সন্তান তোমার পাশে দাঁড়াবে। তুমি আমার চিন্তা করো না। তারপর আরও দুটি মৃতদেহ আমাদের হাসপাতালে আসে। আমি দৌড়ে রিকশার কাছে যাই এবং ভাবতে থাকি এই বুঝি আমার ছেলে হাসপাতালে এলো।’

তিনি আরও বলেন, ‘দুপুর পৌনে ৩টার দিকে আমার হাসপাতালের ডাক্তার বললেন, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে, সজলকে আসতে বল। ওই সময় আমি দুবার সজলকে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু ফোন কেটে দিয়েছে। পরে অনবরত রিং করি। কেউ রিসিভ করেনি। পরে ফোন বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমি সজলের সব বন্ধু-বান্ধবকে ফোন দিয়ে বাইপাইল এলাকায় তার খোঁজ নিতে বলি। তারা বলে অনবরত গুলি হচ্ছে। আমরা খোঁজ নিতে পারছি না। আশুলিয়া থানার সামনে আমরা যেতে পারছি না। আমি নিজে খোঁজ নিতে যেতে পারিনি। কারণ হাসপাতালে প্রচুর গুলিবিদ্ধ আহত লোক আসছিলেন।’ সন্ধ্যায় ছেলের খোঁজে হাসপাতাল থেকে বের হন জানিয়ে জবানবন্দিতে শাহিনা বলেন, ‘আমি সজলের এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আশপাশে যত হাসপাতাল আছে সব হাসপাতালে খোঁজ করেও তাকে পাইনি। আমার স্বামীও বিভিন্ন হাসপাতালে ছেলের সন্ধানে খোঁজখবর করে। খোঁজাখুঁজি করে সজলকে না পেয়ে রাত ৩টার দিকে আমি বাসায় ফেরার উদ্দেশে বাইপাইল মোড়ে আসি। তখন সেখানে লাঠিসোঁটা হাতে পাহারারত ছাত্রদেরকে দেখতে পাই। তাদের কাছে আমার ছেলের সন্ধান জানতে চাই এবং আমার মোবাইলে থাকা ছবি তাদের দেখাই। তখন এক ছেলে আমাকে বলে, আশুলিয়া থানার সামনে ৬-৭টি ছেলেকে হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আপনি সেখানে আপনার ছেলেকে খুঁজে দেখতে পারেন। আমি তখন আশুলিয়া থানায় যেতে চাইলে অন্য ছাত্ররা আমাকে সেখানে যেতে দেয়নি।’ পোড়া জুতা দেখে ছেলের লাশ চিনতে পারেন জানিয়ে জবানবন্দিতে আর্তনাদ করে সজলের মা শাহিনা বলেন, ‘পরদিন ভোর সাড়ে ৬টার দিকে আমি আশুলিয়া থানার সামনে গিয়ে দেখি পুলিশের পিকআপ গাড়িতে বেশ কয়েকটি পোড়া লাশ। অনেক মানুষ লাশগুলোর ছবি ও ভিডিও করছিলেন। আমি ভিড় ঠেলে সামনে যাই এবং একটা ছবি তুলি। আমি দেখতে পাই একটি লাশ এমনভাবে পুড়ে গেছে যে, পায়ের একটি মোটা হাড় উঁচু হয়ে আছে এবং সে হাড়ের সঙ্গে একটি জুতা পোড়া অবস্থায় ঝুলছে। সামান্য টাচ করলেই জুতাটা পড়ে যাবে। জুতাটা দেখেই আমি বুঝতে পারি যে, এই জুতাটি আমার ছেলে সজলের। আমি তখন উপস্থিত সেনা সদস্যদের বলি, এটাই আমার ছেলের লাশ। দয়া করে আমার ছেলের লাশ আমাকে দিয়ে দিন। তখন সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাকে বলেন, এখন লাশ দেওয়ার অনুমতি নেই। অনুমতি পাওয়া গেলে আপনাকে জানাব।

তিনি বলেন, ‘বিকাল আনুমানিক সাড়ে ৪টার দিকে সজলের বন্ধুরা আমাকে ফোন দিয়ে যেখানে লাশ পোড়ানো হয়েছিল সেখানে আসতে বলে। আমি সেখানে বিকাল ৫টার দিকে গিয়ে পৌঁছাই। তখন গাড়ি থেকে একটার পর একটা পোড়া লাশ নামানো হয় এবং শনাক্ত করার চেষ্টা করা হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাকে লাশের কাছে যেতে দেন। সজলের লাশ যখন নামানো হয় তখন তার সঙ্গে তার কর্মস্থলের আইডি কার্ডের আংশিক পোড়া কার্ড এবং মানিব্যাগের ভেতরে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড দেখে আমি আমার ছেলে সজলের লাশ শনাক্ত করি।’

জবানবন্দিতে এই ঘটনার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দায়ী করে তাদের বিচার দাবি করেন নিহত সজলের মা শাহিনা বেগম।