Image description
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন । এসব সংকট মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত নির্বাচন কমিশন । 

‘গ্রহণযোগ্য’ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নানামুখী চ্যালেঞ্জ দেখছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-ইসির ওপর আস্থা ফেরানো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার অনাস্থা ও সংকট নিরসন করা এবং ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিরপেক্ষ ও সক্রিয় ভূমিকায় রাখা, নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অপপ্রয়োগ, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের পক্ষপাতমুক্ত রাখা এবং ভোটকেন্দ্র স্থাপনাও অন্যতম চ্যালেঞ্জ মনে করছে ইসি। প্রথমবার বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার সুযোগ দেওয়াটাও একধরনের চ্যালেঞ্জ মনে করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন ও ইসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্বাচন কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, জুলাই সনদসহ নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সদ্ভাব না থাকলে নির্বাচনে সহিংসতা বাড়বে এবং দেশ-বিদেশে ওই অর্থে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য পাবে না। তারা আরও জানান, গত সপ্তাহে ইসির কর্মকর্তারা সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে বৈঠক করেছেন। সেখানে বেশকিছু বিষয় উঠে এসেছে। এসব বিষয় প্রাধান্য দিয়ে নির্বাচনি প্রচারে এআই-এর ব্যবহার নিষিদ্ধ, আগেভাগেই খসড়া ভোটকেন্দ্রের তালিকা প্রকাশ, আরপিওতে কিছু সংশোধনী যুক্ত করা ও রোডম্যাপে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের ওপর জোর দেওয়াসহ বেশকিছু বিষয় যুক্ত করার পদক্ষেপ নিয়েছে ইসি। তবে ইসির ওপর আস্থা ফেরানো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির মতো কাজে এখনো হাত দেয়নি কমিশন। ভোটের প্রস্তুতিমূলক কাজের দিকেই এখন জোর বেশি দিচ্ছে ইসি। এরই অংশ হিসাবে চলতি সপ্তাহে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে যাচ্ছে কমিশন।

নির্বাচন নিয়ে চ্যালেঞ্জের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ যুগান্তরকে বলেন, চ্যালেঞ্জের শেষ নেই। প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। তবে আমাদের আশা, তফশিল ঘোষণার কাছাকাছি সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবস্থা আরও উন্নতি হবে। এছাড়া নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসাবে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডকে অন্তর্ভুক্ত করে আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) সংশোধন করা হচ্ছে। সুতরাং সবাই মিলে চেষ্টা করলে ভালো পরিস্থিতিতে ভোট করতে পারব।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা নির্বাচনের অ্যাকশন প্ল্যান ঘোষণা করতে যাচ্ছি। সেখানে সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া এবং ভোটার উপস্থিতি কীভাবে বাড়ানো যায়, সেসব বিষয় থাকবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ শেষ করা আমাদের অগ্রাধিকার। এরপর দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরু করব।

স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনও রয়েছে। ২০১৮ সালের কারসাজির নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের ‘আমি-ডামি’ খ্যাত নির্বাচন করার দায়ে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা এবং কাজী হাবিবুল আউয়াল কারাগারে রয়েছেন। কেএম নূরুল হুদাকে ‘মব’ তৈরির পর আটক করা হয়। ওই সময় তার গলায় জুতার মালাও পরানো হয়। বুধবার ইসলামী আন্দোলনের নেতারা প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসব কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

সিইসিকে তারা বলেছেন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে পারলে নির্বাচন দেন। আর যদি আপনি মনে করেন, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে পারবেন না, তাহলে আপনি (নির্বাচনের) ঝুঁকি নেবেন না। কারণ, যদি আপনি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না দিতে পারেন, তাহলে বিগত নির্বাচন কমিশনের পরিণতি আপনাকে ভোগ করতে হবে। আপনার গলায় গামছা এবং কোমরে রশি লাগতে পারে। ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, ওইসব ঘটনা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা এবং ইসির জন্য বড় শিক্ষা। এবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে একই ভাগ্যবরণ করতে হতে পারে। এ কারণে নির্বাচনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেকটাই নিরপেক্ষ থাকবে বলে আশা ইসির। যদিও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশনের যেসব কর্মকর্তা স্থানীয় সরকারের বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি বর্তমান কমিশন।

অবশ্য সুষ্ঠু নির্বাচন করা শুধু ইসির নয়, সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ বলে যুগান্তরকে মন্তব্য করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার। তার মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্যের সুযোগ নিতে পারে সুযোগসন্ধানীরা। তার আশঙ্কা-জুলাই সনদ সই না হলে নির্বাচনে অনিশ্চয়তাও তৈরি হতে পারে। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জুলাই সনদের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। এ সনদ সই না হলে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। ওই অনিশ্চয়তা থেকে বড় সংকট তৈরি হতে পারে। তিনি বলেন, জাতীয় রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সদ্ভাব থাকা দরকার। দলগুলোর মধ্যে যতই অনৈক্য থাকবে, ততই অন্যরা সুযোগ নেবে। এমনকি নির্বাচনের সময় সুযোগসন্ধানীরা নাশকতার মাধ্যমে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। তিনি বলেন, নির্বাচনে ইসি, সরকার ও গণমাধ্যমে নিরপেক্ষতা বজায় রাখাও অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।

রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান অনৈক্য কতটা উদ্বেগের : বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির মধ্যকার বর্তমান অনৈক্য নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে কি না-এ বিষয়ে জানতে চাইলে একাধিক নির্বাচন কমিশনার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কমিশনার বলেন, তফশিল ঘোষণা করা হবে ডিসেম্বরে। এখনো অনেক সময়। এর মধ্যে রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে মনে করছেন তারা।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য নির্বাচনের কৌশল বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর বাহাস একধরনের চাপ তৈরির কৌশল। দ্রুত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সরকারকে তাগাদা দেওয়া এবং সিট ভাগাভাগির কৌশল। তিনি বলেন, একটি দল (আওয়ামী লীগ) ছাড়া সবাই মাঠে আছে। জাতীয় পার্টিও রাজনীতি করছে। সব দল নির্বাচনে অংশ নিলে ভোট প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে এবং ভোটার উপস্থিতি বাড়বে।

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইসি কতটা প্রস্তুত : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন ভোটের প্রস্তুতিমূলক কাজে বেশি মনোযোগী। আরপিও ও নির্বাচন আচরণ বিধিমালা সংশোধন, সীমানা নির্ধারণ, নতুন রাজনৈতি দল নিবন্ধন এবং পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো যেন বিতর্কিত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অনেক ভোটকেন্দ্র তাদের নেতাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ভবন বা এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে। ইসি ইতোমধ্যে নীতিমালা সংশোধন করেছে এবং ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা তৈরি করছে। জনমত যাচাইয়ের জন্য ওই তালিকা আগেভাগেই প্রকাশ করা হবে। এছাড়া তরুণদের নির্বাচনমুখী করতে চলতি বছরে তিনবার হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রকাশ করতে যাচ্ছে। প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো গুছিয়ে আনার পর কৌশলগত কাজগুলোয় হাত দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির।