Image description

অনিরাময়যোগ্য জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত রোগীদেরও এখন উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলছেন চীনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তুলনামূলক কম খরচে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমারসহ আশপাশের দেশগুলোর বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীরা দেশটির কুনমিংয়ের বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিচ্ছেন।

চিকিৎসারত বাংলাদেশি কয়েকজন রোগীর স্বজন চিকিৎসা ব্যয়, পদ্ধতি ও সেবা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সেখানকার কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের একটি সাংবাদিক প্রতিনিধিদল গত ৬ থেকে ৯ আগস্ট চীনের কুনমিংয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে চীন সরকার এ সফরের আয়োজন করে। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।

চীনের ইউনান প্রদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর ও চিকিৎসা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ও চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের গৌরবময় ৫০ বছরের সোনালি অধ্যায় অতিক্রম করেছে। দেশটির অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশ থেকে যারাই চিকিৎসা নিতে আসবেন, তাদের জন্য স্বল্প খরচে সর্বোচ্চমানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা তাদের অন্যতম অঙ্গীকার।

মতবিনিময় সভায় প্রদেশটির হেলথ কমিশনের ডেপুটি ডিরেক্টর ওয়াং জিয়ানকুন বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলকে বলেন, আমাদের সরকার ও ঢাকায় আমাদের দূতাবাস বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে নিবিড়ভাবে কাজ করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের শক্তিশালী বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। কাজেই সেখানকার নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করতে ভূমিকা রাখা আমাদের অন্যতম অঙ্গীকার।

হাসাতালটির প্রেসিডেন্ট জেং ঝিংয়ের কাছে বাংলাদেশি সাংবাদিকরা সেখানার চিকিৎসা ব্যয় ও ভাষাগত সমস্যার বিষয়ে জানতে চান। জবাবে তিনি জানান, আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি বাংলাদেশ থেকে প্রচুর রোগী ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য যান। আমাদের এখানকার চিকিৎসা খরচ ভারতের কাছাকাছি আর সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের চেয়ে বেশ কম। ভাষাগত সমস্যা দূর করতে আমরা দোভাষীর ব্যবস্থা করেছি। আমাদের এখানে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদেরও সুযোগ রয়েছে। এই হাসপাতালে চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চতর গবেষণায় নিযুক্ত আছেন বাংলাদেশি চিকিৎসক ডা. আরিফিন ইসলাম।

ডা. আরিফিন চীনের চিকিৎসাব্যবস্থা ও বাংলাদেশি রোগীদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কথা বলেন সফররত সাংবাদিকদের সঙ্গে। তিনি বলেন, এখানকার ডাক্তাররা রোগীর প্রতি বিশেষ নজর দিয়ে থাকেন। একজন ডাক্তারের বিপরীতে তিনজন নার্স রয়েছেন। রোগীদের সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের আওতায় রাখা হয়।

ডা. আরিফিন আরো বলেন, কুনমিংয়ের রোবটিক সার্জনরাও বেশ দক্ষ। তাদের পশ্চিমা দেশগুলোয় সার্জারির বিশেষ অভিজ্ঞতা থাকায় রোগীরা কম খরচে উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা পেয়ে আসছেন। এখানে বাংলাদেশি মুদ্রায় আড়াইশ টাকার মধ্যে যে কোনো ভালোমানের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানো সম্ভব। ডাক্তাররা বেশ অভিজ্ঞ হওয়ায় রোগ নির্ণয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। ওষুধও খুব কম ব্যবহার করেন এখানকার ডাক্তররা।

হাসপাতালটির ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল বিভাগের পরিচালক হ্যান রুই বলেন, গত ছয় মাসে এই হাসপাতালে বাংলাদেশের ৬৭ জন রোগী চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছেন। তারা লিভার সিরোসিস, ক্যানসারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এই হাসপাতালে আরো বেশি বাংলাদেশি চিকিৎসকদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে চীন সরকার উদ্যোগ নেবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

কুনমিং টংগ্রেন হাসপাতালের ভাইস প্রেসিডেন্ট শেন লিং জানান, বিশ্বের সর্বোচ্চমানের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে তাদের হাসপাতাল। এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ভর্তি হয়েছেন বাংলাদেশের এক রোগী। তার বড় ভাই ওমর ফারুক শাহেদি সফররত সাংবাদিকদের বলেন, চারদিন আগে তার ছোট ভাইকে এখানে ভর্তি করিয়েছেন। তার মেরুদণ্ডের হাড় প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। গত তিন বছর ধরে তার মেরুদণ্ড ও ডান পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা ছিল। দেশের কোনো ডাক্তার তার রোগ নির্ণয় করতে পারেননি। পরে ভারতের চেন্নাইয়েও যান ভাইকে নিয়ে। সেখান থেকেও ফেরত আসেন। চোখের সামনে ছোট ভাইয়ের ছটফটানি সহ্য করতে পারেননি। পরে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে এই হাসপাতালের সন্ধান পান। ইন্টারনেটে যোগাযোগ করে দেশ থেকে আগের চিকিৎসার সব কাগজপত্র এখানে পাঠালে তারা চিকিৎসার নিশ্চয়তা দেন।

শাহেদি বলেন, দুদিন আগে তার ভাইয়ের অপারেশন হয়েছে। জটিল অপারেশনের মাধ্যমে তার হাড় প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এর আগে তার চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আমার সঙ্গে আড়াই ঘণ্টা পরামর্শ করেন সার্জন। সে এখন ভালো আছে।

কেমন খরচ হয়েছেÑজানতে চাইলে শাহেদি বলেন, এখানে যা খরচ হয়েছে, ভারত ও বাংলাদেশের ডাক্তারদের পেছনে ঘুরে গত তিন বছরে তার চেয়ে বেশি খরচ করেছি। সেখানে তো চিকিৎসা হয়নি।

চীনে বাংলাদেশি রোগীদের উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশিদের জন্য যৌক্তিক খরচে এবং স্বল্প সময়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালেশিয়ার বাইরে একাধিক বিকল্প গন্তব্যের অনুসন্ধান শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় কুনমিংয়ে বাংলাদেশিদের চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে চীন সরকার কুনমিংয়ের তিনটি প্রধান হাসপাতাল এবং পরে দূতাবাসের অনুরোধে কুনমিং বিশেষায়িত ক্যানসার হাসপাতালকেও বাংলাদেশি নাগরিকদের চিকিৎসার জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করে। এর মধ্যে কুনমিং মেডিকেল বিশ্যবিদ্যালয়ের অধীন ফার্স্ট অ্যাফিলিয়েটেড হাসপাতাল এবং ইউনান ফার্স্ট পিপলস হাসপাতাল দুটি সাধারণ হাসপাতাল। সেখানে সাধারণত সব রোগের উন্নত চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া যায়। অন্যদিকে ফু-ওয়াই কার্ডিওভাসকুলার হাসপাতাল এবং ইউনান ক্যানসার হাসপাতাল দুটি বিশেষায়িত হাসপাতাল, যেখানে হৃদরোগ এবং ক্যানসারের চিকিৎসা হয়।

আবুল কালাম আজাদ জানান, পরে উশি শহরের প্রধান হাসপাতালটিও পাইলট হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করার মাধ্যমে তা বাংলাদেশি রোগীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই পাঁচটি হাসপাতালে আন্তর্জাতিক বিভাগ খোলা হয়েছে এবং বাংলাদেশসহ বিদেশি রোগীদের জন্য ইংরেজিভাষী ডাক্তার এবং নার্স, হালাল রেস্তোরাঁ, অনুবাদ সেবাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবা চালু করা হয়েছে।

আবুল কালাম আজাদ বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে বেইজিংয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈঠকে চিকিৎসা সহযোগিতা জোরদারের বিষয়ে আলোচনা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত মে মাসে চীন সরকার দেশটির সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতাল বাংলাদেশিদের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করে। ইউনানের চুজিং, ডালিসহ বিভিন্ন শহরের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কুনমিংয়ের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশেষায়িত হাসপাতাল চক্ষু, শিশুরোগ, ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।

আবুল কালাম আজাদ জানান, ইতোমধ্যে চীন সরকার চিকিৎসাপ্রত্যাশী এবং তাদের সঙ্গীদের ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া সহজ এবং গ্রিন চ্যানেল চালুর মাধ্যমে ভিসা প্রক্রিয়াকরণ এবং ডেলিভারি দ্রুত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এছাড়া বিপুলসংখ্যক রোগীর আসা-যাওয়া নির্বিঘ্ন করতে এবং বাংলাদেশ ও ইউনানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতাসহ চিকিৎসা পর্যটন সহজ করার লক্ষ্যে সরকারিভাবে কুনমিং ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট চালু এবং ঢাকা ও কুনমিংয়ের মধ্যে একাধিক ফ্লাইট চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ চট্টগ্রাম-কুনমিং রুটে নতুন ফ্লাইট চালু হলে রোগী ও ব্যবসায়ীদের যাতায়াত আরো নির্বিঘ্ন হবে বলে জানান ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি।