Image description
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয়জনকে গুলি করে হত্যা মামলায় ট্রাইব্যুনালে আরও তিনজনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। 
 
জবানবন্দিতে শহীদ ইয়াকুবের মা রহিমা আক্তার বলেন, ‘গত বছরের ৫ আগস্ট বেলা আড়াইটার দিকে লোকজন আমার ছেলের লাশ খাটিয়ায় করে গলির ভেতর নিয়ে আসে। ছেলের শরীর থেকে তখনো খাটিয়া বেয়ে অনেক রক্ত পড়ছিল। তারপর কাপড় সরিয়ে দেখি, পেটে গুলি লেগে পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে, রক্ত পড়া থামছে না।’ ছেলের মৃত্যুর বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। 
 
এদিকে অপর সাক্ষী শহীদ আহম্মেদ তার জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশের পোশাক পরিহিত লোকদের হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শুনেছেন।
 
এদিন শহীদ ইয়াকুবের (৩৫) চাচা নাজিমুদ্দিন রোডের শহীদ আহম্মেদ (৪০) ও শহীদ ইসমামুল হকের (১৭) ভাই চট্টগ্রামের মহিবুল হক (২১) সাক্ষ্য দেন। ইয়াকুব ছিলেন ঢাকার নিউমার্কেটের একটি প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারিম্যান। তিনি নাজিমুদ্দিন রোডের শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজের পাশে মিলি গলির বাসিন্দা।
 
পরে সাক্ষীদের জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এ নিয়ে মামলায় ৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হলো। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ২০ আগস্ট দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১-এ বুধবার এ সাক্ষ্যগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
 
মামলায় আটজন আসামির মধ্যে সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল পলাতক। আর গ্রেফতার আছেন শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন, সাবেক কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলাম। বুধবার তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
আদালতে প্রসিকিউশনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এমএইচ তামিম ও বিএম সুলতান মাহমুদসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। আসামিপক্ষে অ্যাডভোকেট আবুল হোসেন, সাদ্দাম হোসেন ও রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী কুতুব উদ্দিন আহমেদ শুনানি করেন।
 
মা রহিমা বলেন, ‘আমার ছেলে ৫ আগস্ট চানখাঁরপুল নাজিমুদ্দিন রোডে আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়। খবর শুনে আমি চিৎকার করে বের হয়ে গলিতে যাই। মহল্লার লোকজন আমাকে যেতে দেয়নি। আমাকে জানায় আমার ছেলে সুস্থ আছে। তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমার ছেলের বয়স ছিল ৩৫ বছর। প্রতিবেশীরা কান্নাকাটি শুরু করলে আমার সন্দেহ হয়, আমার ছেলের কিছু হয়েছে। বেলা ২টার দিকে দেখি আমার ছেলের লাশ খাটিয়ায় করে গলির ভেতর নিয়ে আসে। শহীদসহ (প্রতিবেশী) অনেকেই ছিল। ছেলের শরীর থেকে তখনো রক্ত পড়ছিল। কাপড় সরিয়ে দেখি ভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে, রক্ত পড়া থামছে না।’ 
 
তিনি জানান, তিনি পরবর্তী সময়ে টিভি নিউজ, ভিডিও এবং বিভিন্ন মাধ্যমে দেখেন যারা গুলি করেছে, তারা ছাপা কাপড়ের পোশাক পরিহিত ছিল। পুলিশের গুলিতে তার ছেলে পড়ে যান। প্রতিবেশী শহীদ এই দৃশ্য তার মোবাইল ফোনে ধারণ করেন। রহিমা ছেলের হত্যাকাণ্ডে জড়িত এবং নির্দেশদাতা সবার বিচার চান। এ সময় তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নাম বলেন নির্দেশদাতা হিসাবে।
 
পুলিশের পোশাক পরা লোকদের হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শুনি : রহিমার পর সাক্ষ্য দেন প্রতিবেশী শহীদ আহম্মেদ (৪০)। তিনি বলেন, ‘আমি, আমার ভাতিজা ইয়াকুব, ছেলে সালমান, এলাকার রাসেল, সুমন, সোহেলসহ আরও অনেকে বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে গণভবনের উদ্দেশে রওয়ানা দিই। আনুমানিক সাড়ে ১১টায় আমরা চানখাঁরপুল এলাকায় পৌঁছালে সেখানে হাজার হাজার লোক চারদিক থেকে জড়ো হচ্ছিল। তখন দেখলাম চানখাঁরপুল মোড়ের উলটা পাশে অনেক পুলিশ, ছাপা পোশাকধারী পুলিশ ছিল। পুলিশের পোশাক পরিহিত লোকদের হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শুনি।’ তিনি বলেন, পুলিশ তাদের বাধা দেয় এবং তাদের লক্ষ্য করে ফাঁকা গুলি করে। ওই সময় তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। আবার তারা সামনে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে গুলি করে। ‘আমার পাশের একজনের পায়ে গুলি লাগে। তাকে আমি সরাচ্ছিলাম। তখন আমাকে একজন বলে আপনার ভাতিজা ইয়াকুবের গায়ে গুলি লেগেছে। আমি ওই ছেলেকে আরেকজনের কাছে রেখে ভাতিজার কাছে যাই। আরও দুইজনসহ ভাতিজাকে অটোরিকশায় করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাই। কর্তব্যরত ডাক্তার বলেন, ইয়াকুব মারা গেছে।’
 
শহীদ বলেন, পরে জেনেছি শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন। ডিএমপির মো. ইমরুল, ইনস্পেকটর আরশাদের উপস্থিতিতে কনস্টেবল সুজন, নাসিরুল, ইমাজ গুলি করেছিল। আরও অনেকেই ছিল। এ সময় আসামিপক্ষের এক আইনজীবী আসামিদের নাম পাশে থেকে প্রসিকিউশন শিখিয়ে দিচ্ছে বলে ট্রাইব্যুনালের কাছে অভিযোগ করেন। 
 
কাঠগড়ায় থাকা আসামি শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন বলেন, আমার নাম সাক্ষী বলেননি, তারপরও প্রসিকিউশনের আইনজীবীরা আমার নাম বলে দিয়েছে। ট্রাইব্যুনাল এ সময় যথাযথ নিয়মে জবানবন্দি দেওয়ার জন্য সাক্ষীকে বলেন। সাক্ষী নামগুলো আবার বলেন।
 
ভাইয়ের হত্যাকারী এবং নির্দেশদাতাদের শাস্তি দাবি করেন মহিবুল : পরে সাক্ষ্য দেন মো. মহিবুল হক (২১), তার বাড়ি চট্টগ্রামে। তিনি বলেন, ‘আমি সেদিন বাড়িতে ছিলাম। আমার ভাই ইসমামুল হক ঢাকা চানখাঁরপুলে শহীদ হয়েছে। দুপুর ১টার দিকে আমার ভাই শহীদ ইসমামুলের মোবাইল থেকে জনৈক ব্যক্তি আমাকে কল করে জানায় যে আমার ভাই পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি আছে।’ 
 
ইসমামুল চকবাজার গফুর সওদাগরের দোকানে কাজ করতেন জানিয়ে মুহিবুল বলেন, ‘আমি তাকে ফোন করলে তিনি হাসপাতালে গিয়ে ইসমামুলের খোঁজ খবর নেন। যান চলাচল বন্ধ থাকায় আমরা সেদিন ঢাকায় আসতে পারিনি। পরের দিন ৬ আগস্ট আসি, ঢাকায় এসে জানতে পারি, আমার ভাইকে মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। আনুমানিক সন্ধ্যা ৬টার দিকে আমরা গফুর সওদাগরকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই। সেখানে আমার ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের সামান্য কথাবার্তা হয়। সে সিসিইউতে ছিল। তার অবস্থার অবনতি হলে রাত ১০টার দিকে তাকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। ৭ আগস্ট সকালে তার অবস্থার অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সেদিন বিকাল ৪টার দিকে সে ইন্তেকাল করে।’
 
চিকিৎসকরা তার ভাইয়ের ময়নাতদন্ত করেননি উল্লে­খ করে তিনি বলেন, ‘আমরা ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে ইসমামুলের লাশ নিয়ে চট্টগ্রামে নিজ বাড়িতে যাই। ঢাকা থেকে সন্ধ্যা ৬টায় রওয়ানা দিয়ে রাত ২টায় চট্টগ্রামে নিজ বাড়িতে পৌঁছি।’ পরদিন জানাজা শেষে ইসমামুলের মরদেহ নিজ গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয় বলে মহিবুল ট্রাইব্যুনালকে জানান।
 
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, এডিসি আক্তারুল ইসলাম, ইমরুল এবং আরশাদের নির্দেশে সুজন হোসেন, নাসিরুল ইসলাম, ইমাজ হাসান ইমনসহ আরও অনেকে গুলি করেছেন বলে তিনি তার সাক্ষ্যে বলেন। ভাইয়ের হত্যাকারী এবং নির্দেশদাতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন মহিবুল।