
দেশের সড়ক ও মহাসড়কে বছরে ৫৭০০টি দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে মারা যাচ্ছেন প্রায় ৮ হাজার মানুষ। আর আহত হচ্ছেন ১৪ হাজারের বেশি। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১১ বছরের সড়ক দুর্ঘটনা, মৃত্যু ও আহতের চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে সূচক ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র মিলেছে। এদিকে যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সারা দেশে মাসে দুর্ঘটনা ঘটছে ৪৭৫টি, নিহত ৬৬৪ জন এবং আহত ১১৬৮ জন। দৈনিক দুর্ঘটনা ঘটছে ১৫টি, নিহত হচ্ছেন ২২ জন এবং আহত হচ্ছেন ৩৮ জন।
সড়কে শৃঙ্খলা না থাকায় দুর্ঘটনা বাড়ছে। চালকদের বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত ট্রিপ, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ব্যবহার, মাদক সেবন, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, নজরদারি এবং তদারকির অভাব এবং চালকদের অদক্ষতাও দুর্ঘটনার বড় কারণ। এছাড়া চালকদের ৭৩ ভাগেরই চোখের সমস্যা আছে। ৬০ শতাংশ চালক উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিকসসহ নানা রোগে আক্রান্ত। গাড়ি চালানোর জন্য যে ধরনের শারীরিক সুস্থতা দরকার, এসব চালকের তা নেই। ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়ায়ও অস্বচ্ছতা আছে। সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করেই অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ পথে অদক্ষ চালককে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে।
জানা গেছে, বিগত ১১ বছরে সড়কে মোট দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬২ হাজার ৭১৫টি। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৯৬৮ জন এবং আহত হয়েছেন ১৪ হাজার ২৩ জন। ২০১৪ সালে মোট দুর্ঘটনা হয়েছিল ৫ হাজার ৯২৮টি। এরপরের বছরগুলোতে কখনো দুর্ঘটনা কিছুটা কমেছে আবার কোনো বছর কিছুটা বেড়েছে। তবে ২০২৪ সালের মোট দুর্ঘটনার হয়েছিল ৬ হাজার ৩৫৯টি। দুর্ঘটনার ১৪ শতাংশ বাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের দুর্ঘটনা ২৮.৩৯ শতাংশ এবং মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ২৪.৮০ শতাংশ।
তথ্য বিশ্লেষণে আরও জানা গেছে, ২০১৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহত ৮৫৮১ জন। এরপরের বছর এ চিত্র কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৬৪২ জন। পরের বছরগুলোতে মৃত্যুর হার কিছুটা উঠানামা করলেও কাছাকাছি জায়গায় ছিল। সবশেষ ২০২৪ সালে সড়কে মৃত্যু ৮ হাজার ৫৪৩ জন। একইভাবে ২০১৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট আহত হয়েছিলেন ১৭ হাজার ৫২৪ জন। পরের বছরগুলোতে আহতের সংখ্যা কিছুটা উঠানামা করেছে। ২০২৩ সালে এই চিত্র ছিল ১০ হাজার ৩৭২ জন। তবে পরের বছর অর্থাৎ ২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৬০৮ জন।
সড়কে দুর্ঘটনার কারণ : বাংলাদেশের সড়ক পরিবহণ খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের পরিবহণ খাতের বেশ কিছু সমস্যা বিরাজমান। আইন হলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বাস্তব পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণায়, বাংলাদেশের সড়ক ও মহাসড়কগুলোয় দুর্ঘটনার পেছনে বেপরোয়া গাড়ি চালানোসহ বেশকিছু কারণ বেরিয়ে এসেছে। সেগুলোর মধ্যে আছে-১. বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো ২. চালকের অতিরিক্ত ট্রিপ ৩. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ৪. নজরদারি এবং তদারকির অভাব ৫. চালকদের অদক্ষতা। এআরআইর গবেষণায় আরও বেরিয়ে এসেছে, সড়কে দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে-চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ব্যবহার, মাদক সেবন, চালকের বেপরোয়া মনোভাব ইত্যাদি। চালকদের ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স’ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা এবং সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করা। চালকরা যথাযথ প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় অনেকে সড়কের চিহ্ন এবং আইনকানুন সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। অনেক ক্ষেত্রে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্সও থাকে না।
চালকদের স্বাস্থ্য সমস্যা প্রকট : সড়কের বাস, ট্রাক এবং অন্যান্য যানবাহনের চালকদের চোখের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ঢাকা আহছানিয়া মিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাড়ি চালকদের ৭৩ ভাগেরই চোখের সমস্যা রয়েছে। জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ২০২৩ এ প্রতিষ্ঠানটি সারা দেশের ৮২৪ জন চালকের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় এ চিত্র বেরিয়ে আসে। একইভাবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ২০২৩ সালের জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসে সারাদেশে গাড়ি চালকদের চোখ পরীক্ষা করেন। ২৮৯ চোখের পরীক্ষায় বেরিয়ে আসে ৮১ শতাংশ চালকের চোখে সমস্যা রয়েছে, যার চিকিৎসা না করে গাড়ি চালানো রীতিমতো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
উত্তরণের উপায় : সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ এবং হতাহত কমাতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তাহলে সড়কের মৃত্যুর মিছিলের সূচক কমে আসবে। দেশের সড়ক ও মহাসড়কগুলো নিরাপদ হয়ে উঠবে। পরিবহণ খাতসংশ্লিষ্টরা বলেন, এখন দেশে ১৭ কোটি ৫৭ লাখ মানুষ। আর সড়কে যানবাহনের সংখ্যা ৬০ লাখেরও বেশি। স্বল্প পরিমাণ সড়কে বিপুলসংখ্যক যানবাহন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে সবার আগে প্রয়োজন চালকদের সচেতনতা। তাদের লাইফস্টাইলে নিয়মানুবর্তিতা আনতে হবে। তাহলে দুর্ঘটনা যেমন কমবে, সড়কে ফিরবে শৃঙ্খলা। তারা আরও বলেন, সড়কে চালককে রক্ষণাত্মকভাবে গাড়ি চালাতে হবে। বৃষ্টির সময় গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে অতি সাবধান থাকতে হবে। চলন্ত অবস্থায় ঘুম পেলে কোথাও গাড়ি থামিয়ে একটু ন্যাপ (স্বল্পমেয়াদি ঘুম) নিতে হবে। এছাড়া গাড়ির দুপাশের আয়না এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যে, যেন পেছনের ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত যাতে পরিষ্কার ভাবে দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞরা যা বললেন : এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক এবং যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক যুগান্তরকে বলেন, সড়ক ও মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটনার যত ধরনের নিয়ামক থাকা দরকার, তার সব বাংলাদেশে আছে। দিনে দিনে এটা বাড়ছে। যাদের বিষয়টি দেখা দরকার তারা দেখছে না। এ কারণে দুর্ঘটনা এবং হতাহত কমছে না।
তিনি জানান, সড়কের শৃঙ্খলা দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু বাংলাদেশের সড়কে শৃঙ্খলা বলতে কিছুই নেই। আগে বাসের বিপরীতে ছোট যানবাহন ছিল শুধু রিকশা। কিন্তু এখন লাফিয়ে লাফিয়ে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক বেড়েছে। এসব যানবাহন সড়কে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। এছাড়া চালকদের সড়কে গাড়ি চালানোর বিষয়ে যে ধরনের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দরকার সেটাও নেই। এ ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা সেসব কাজ বাস্তবায়ন করছে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পরিবহণ খাতের বিশৃঙ্খলার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা কমছে না। দায়িত্বপ্রাপ্তদের এই বিশৃঙ্খলা শক্ত হাতে দমন করতে হবে। তিনি বলেন, দেশের বেশির ভাগ পরিবহণ চালকদের দিয়ে বেশি পরিশ্রম করানো হচ্ছে। পাশাপাশি ভারী যানবাহনের বড় ধরনের সংকট রয়েছে। চালক তৈরির ব্যাপারেও সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ নেই।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : এ বিষয়ে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, দেশের সড়ক ও মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা রয়েছে। সেজন্য দুর্ঘটনা ঘটে, সেসব কমিয়ে আনতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের উদ্যোগ রয়েছে। তবে সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ বাস, মিনিবাস, ট্রাক ও পণ্যবাহী যানের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে, যেটা চলমান রয়েছে। তিনি জানান, পরিবহণ মালিকদের বলা হয়েছে, তারা যেন নিজেরা বাস-ট্রাকগুলো সরিয়ে নেন, সেটা মঙ্গলজনক হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মিছিল লম্বা হচ্ছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সহযোগিতা প্রয়োজন।