
ঢাকার নতুন অফিসপাড়ায় সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য নির্মিত বিলাসবহুল আবাসন প্রকল্প যেন উন্নত দেশের পাঁচতারকা হোটেলের এক মডেল। বিশাল আয়তনের ১ হাজার ৫১২টি ফ্ল্যাটের মধ্যে চারটি জোনে বিভক্ত আবাসিক ভবনে রয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, শপিংমল, লেকপাড় প্লাজা, ব্রিজ, প্লে জোনসহ কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে, যার অডিটোরিয়ামের ছাদে রয়েছে সুইমিংপুল। অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা, কিচেন, কেবিনেট, ওয়াল আলমিরা ও ফলস সিলিংয়ের মতো বিলাসিতাও চোখে পড়ার মতো। ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গড়তে যাওয়া এ প্রকল্পের প্রতিটি রাস্তার বর্গমিটারে হাজার হাজার টাকা খরচ করার আয়োজন চলছে। আধুনিক সিকিউরিটি সিস্টেম, সোলার স্ট্রিট লাইট, ক্লোজড ড্রেন ও উন্নত পানি সরবরাহসহ নানা সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে, যা ঢাকার সরকারি আবাসনের এক বিলাসবহুল ছবি ফুটিয়ে তোলে।
নথিপত্র বলছে, পুরো প্রকল্পে ইউটিলিটি ভবন হিসেবে গণপূর্তের অফিসসহ ৪৯টি ভবন নির্মাণ করা হবে। এর মোট ব্যয় দাঁড়াবে ৩ হাজার ৯৮৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ৪৩ একর জমিতে ১ হাজার ৫১২টি পরিবারের জন্য উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান নিশ্চিত করার মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আরও উন্নত সেবা প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় ধরায় বিভিন্ন মহলে সমালোচনার মুখে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা কমিয়ে ৩৬শ কোটি টাকার মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পের ডিপিপি অনুযায়ী, ২৫০০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাটবিশিষ্ট একটি ১০-তলা ভবন নির্মিত হবে, যার আয়তন ১৩০৫০ বর্গমিটার; ১৮০০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাটবিশিষ্ট ১১টি ১০-তলা ভবন হবে, মোট আয়তন ১৩০৪৯৫ বর্গমিটার; ১৫০০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাটবিশিষ্ট ১১টি ১০-তলা ভবনের আয়তন ১১৬৭১৯ বর্গমিটার; ১২৫০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাটবিশিষ্ট ২০টি ১০-তলা ভবনের মোট আয়তন ২০০৫০২ বর্গমিটার।
চার নম্বর জোনে চারটি করে তিনতলা ফ্যাসিলিটি ভবন নির্মাণ করা হবে, যার আয়তন ১০৮৭৩.৪৭ বর্গমিটার। একটি ছয়তলা কমিউনিটি ফ্যাসিলিটি জোনে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, শপিং মল, কমিউনিটি সেন্টারসহ পাঁচটি ভবন নির্মাণ করা হবে, যার আয়তন ৪৩৫৭৩ বর্গমিটার। গণপূর্ত স্টাফদের জন্য একটি ১০-তলা ডরমিটরি ভবন নির্মাণ হবে, যার আয়তন ১৬৫১৪ বর্গমিটার।
প্রকল্পে ফ্ল্যাট আয়তনের ভিত্তিতে জোন-এ, বি, সি ও ডি চারটি জোনে বিভক্ত করে আবাসিক এলাকাগুলোর মধ্যে সেগ্রিগেশন ওয়াল নির্মাণের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ব্রিজ থাকবে যানজট এড়াতে। আধুনিক সিকিউরিটি সিস্টেম, ক্লোজড ড্রেন, অভ্যন্তরীণ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা, কনসিল্ড ইন্টারনেট লাইন, সোলার স্ট্রিট লাইট স্থাপন, গভীর নলকূপ থেকে পানি সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, উচ্চমানের লিফট ইত্যাদি সুবিধা থাকবে। গাড়ি পার্কিং সুবিধার জন্য প্রতিটি আবাসিক ভবনে দুটি বেজমেন্ট থাকবে।
কমিউনিটি ফ্যাসিলিটির জন্য একটি ছয়তলাবিশিষ্ট কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন, জেনারেটর, লিফট, রাস্তা, সীমানা প্রাচীর, গেট, এসটিপি, ডাম্পিং জোন, খেলার মাঠসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
ভূমি উন্নয়নের জন্য ৭৫৭০২ ঘনমিটারের কাজের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৩ লাখ টাকা। মাটি পরীক্ষা খরচ ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। ১২৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটবিশিষ্ট ২০টি ১০-তলা ভবন (জোন-এ ও বি) নির্মাণের ব্যয় ১ হাজার ১৮০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ১৫০০ বর্গফুট ফ্ল্যাটবিশিষ্ট ১১টি ১০-তলা ভবন (জোন-সি) নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৮৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ১৮০০ বর্গফুট ফ্ল্যাটবিশিষ্ট ১০টি এবং একটি ২৫০০ বর্গফুট ফ্ল্যাটবিশিষ্ট ১০-তলা ভবন (জোন-ডি) নির্মাণ ব্যয় ৮৫৭ কোটি ৯ লাখ টাকা।
চারটি জোনে চারটি করে তিনতলা ফ্যাসিলিটি ভবন নির্মাণ ব্যয় ৪০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। একটি কমিউনিটি ফ্যাসিলিটি জোনে ছয়তলাবিশিষ্ট পাঁচটি ভবন নির্মাণ ব্যয় ২১৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। একটি ছয়তলা গণপূর্ত ডরমিটরি ও একটি রক্ষণাবেক্ষণ অফিস নির্মাণে ব্যয় ৪৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। চার জোনে বহিস্থ স্যানিটেশন ও পানি সরবরাহে ব্যয় ১০২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। বহিস্থ বিদ্যুতায়নের ব্যয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। আনুষঙ্গিক কাজের জন্য বরাদ্দ ৩৭৬ কোটি ৬ লাখ টাকা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যয় ১৬ কোটি ৬ লাখ টাকা। ফিজিক্যাল ও প্রাইস কনটিনজেন্সি হিসেবে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫৪ কোটি টাকা।
মান নিয়ন্ত্রণের জন্য কাঁচামালের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা খরচ ২ কোটি টাকা। আর্কিটেকচারাল, থ্রিডি মডেল নকশা, কাঠামোগত নকশা, প্লাম্বিং নকশা ও বৈদ্যুতিক নকশার ব্যয় ৭৫ লাখ টাকা। বিজ্ঞাপন ও টেন্ডার ডকুমেন্টসের খরচ ২৫ লাখ টাকা। কমিটির সদস্যদের সম্মানী ১৫ লাখ ১১ হাজার টাকা। মিটার, সংযোগ লাইন ও ডেস্কো চার্জ প্রায় ১৮ কোটি টাকা। ওয়াসা চার্জ ৪৮টি জলাধারের জন্য ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। নিরাপত্তার জন্য আনসার ১৫ জনের বেতন ১ কোটি ১২ লাখ টাকা। অফিস ভাড়া, আপ্যায়ন ও ইউটিলিটি চার্জ ৯১ লাখ টাকা। অপ্রত্যাশিত ব্যয় ২৫ লাখ টাকা। পরিদর্শন যান ভাড়া (জ্বালানি ও ড্রাইভারসহ) একটি জিপ ও চারটি ডাবল কেবিন পিকআপের জন্য ৩ কোটি টাকা। কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাদি (১৫ জন) ৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
কমিউনিটি সেন্টারের ছাদে নির্মিত সুইমিংপুলের ব্যয় ২ কোটি ৮১ লাখ টাকা। লেকপাড় ওয়াকওয়ের ব্যয় সাড়ে ৩ কোটি টাকা। বোটহাউস (দুটি একতলা ভবন) নির্মাণ ব্যয় ৮১ লাখ টাকা। লেকপাড় প্লাজার আয়তন ১১৫০ বর্গমিটার, ব্যয় ৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। যানবাহন ও পথচারী চলাচলের জন্য ১০টি ব্রিজ নির্মাণে ব্যয় ৪৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। চারটি জোনের শিশুদের জন্য প্লে জোন নির্মাণে ব্যয় ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
আনুষঙ্গিক কাজের মধ্যে সীমানা প্রাচীর ৪৯৮৬ মিটার দীর্ঘ, যার ব্যয় ১৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা (প্রতি মিটারে ৩৪৬৩৬ টাকা)। গেট নির্মাণ ব্যয় ২৬ লাখ টাকা। গার্ড হাউসের ব্যয় ২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ভূগর্ভস্থ সার্ভিস টানেল নির্মাণ ব্যয় ১২২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। আরসিসি রাস্তার মোট দৈর্ঘ্য ২৪৭১৩ বর্গমিটার, ব্যয় ২০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা (প্রতি বর্গমিটারে ৮২৫০ টাকা)। ওয়াকওয়ের মোট দৈর্ঘ্য ১৮১৩৪ বর্গমিটার, ব্যয় ১২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা (প্রতি বর্গমিটারে ৬৯৬৪ টাকা)। অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা (কিচেন, কেবিনেট, ওয়াল আলমিরা, ওয়াল প্যানেলিং ও ফলস সিলিং) খরচ ৭৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা।
প্রকল্প চলাকালে নিরাপত্তার জন্য সেফটি ক্যানোপি, সেফটি নেট, সার্ভিস লিফট ও বেজমেন্টে রেইন প্রটেকশন নির্মাণে ব্যয় ৩৭ কোটি ১০ লাখ টাকা, যার প্রতি বর্গমিটারে খরচ ধরা হয়েছে ১৫২২ টাকা।
বহিস্থ স্যানিটেশন ও পানি সরবরাহের জন্য ডিপ টিউবওয়েল ও ডিস্ট্রিবিউশন লাইনসহ ছয়টি স্থানে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা, যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। সিডওয়েজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট পাঁচটি নির্মাণে ব্যয় ১৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ভূগর্ভস্থ জলধারা ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাসহ ব্যয় ১৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ পাঁচ হাজার গ্যালন ধারণক্ষম ৪৪টি ট্যাঙ্ক নির্মাণে ব্যয় ৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। পানি বিশুদ্ধকরণ ব্যবস্থা ১৫৫২টি স্থানে নির্মাণে ব্যয় ১৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা (প্রতিটি স্থানে প্রায় ১ লাখ টাকা)।
ভবন থেকে সার্ভিস টানেল পর্যন্ত সিওয়াজ লাইন নির্মাণে মোট দৈর্ঘ্য ২০৪৩৭ মিটার, ব্যয় ৩০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা (প্রতি মিটারে ১৫৮৭০ টাকা)। সেপটিক ট্যাঙ্ক ও পরিদর্শন পিট ৪৭৪টি নির্মাণ ব্যয় ২ কোটি ১০ লাখ টাকা।
বিদ্যুতায়নের জন্য ১৩টি সাবস্টেশন স্থাপন করা হবে (৬টি ১৬০ কেভিএ, ৪টি ১০০০ কেভিএ, ২টি ১২৫০ কেভিএ এবং ১টি ৬৩০ কেভিএ এইচটি এলটি প্যানেল)। মোট ব্যয় প্রায় ৪৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। ৮৮টি লিফট (প্যাসেঞ্জার ও ফায়ার) স্থাপনে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ১৬৭টি পাম্প মোটর সেট (সাবমার্সিবল ও স্ট্যান্ডবাইসহ) নির্মাণ ব্যয় ৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। বজ্রনিরোধক ছয়টি স্থাপনে ব্যয় ১ কোটি ৭২ লাখ টাকা। সিসিটিভি সিস্টেম ছয়টি স্থাপনে ব্যয় ৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা। পিএবিএক্স বা ইন্টারকম সিস্টেম ছয়টি স্থাপনে ব্যয় ৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। পিএ ও সাউন্ড সিস্টেম ছয়টি স্থাপনে ব্যয় ২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। সোলার সিস্টেম ৪০৭ কিলোওয়াট ক্ষমতার ব্যয় ৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। কম্পাউন্ড সিকিউরিটি লাইট স্থাপনায় ব্যয় ৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। কমিউনিটি সেন্টার ও মসজিদের জন্য ভিআরএফ বা এসপিটিআই টাইপ এয়ার কুলার স্থাপনায় ব্যয় ২ কোটি টাকা। অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ১১টি স্থাপনায় ব্যয় ৩৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। ফোর্স ভেন্টিলেশন ছয়টি স্থাপনায় ব্যয় ১৩ কোটি ৬ লাখ টাকা। কম্পিউটার, প্রিন্টার, ফটোকপি, প্লটার ও আসবাবপত্রের ব্যয় ২৪ লাখ টাকা। ভবন রক্ষণাবেক্ষণ যন্ত্রপাতি ব্যয় ৩০ লাখ টাকা। আরবরিকালচার ও ল্যান্ডস্ক্যাপিং ব্যয় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ পারভেজ খাদেম কালবেলাকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, তা বাস্তবায়নের সমস্যা হবে না। বর্তমানে যে রিট শিডিউল আছে, সে অনুযায়ী ব্যয় ধরা হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ কালবেলাকে বলেন, ৪৩ একর জমিতে ১৫১২টি পরিবারের জন্য ৩৯৮৪ কোটি টাকা ব্যয় এটা অতিরিক্ত মনে হচ্ছে। এসব প্রকল্পে স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে সবই রাখতে হবে আর না হয় আশপাশের এলাকায় এর প্রভাব পড়বে। জাতীয় আবাসন নীতিমালায় বলা হয়েছে, নিম্নবিত্তদের জন্য আবাসনের কথা; কিন্তু আবাসনের জন্য যে অর্থ, তা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনে চলে যাচ্ছে।