
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে বিতর্ক চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগেই জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি তথা সাংবিধানিক স্বীকৃতি চায় জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপিসহ কয়েকটি ইসলামী ও সমমনা দল। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মত কোনো ঘোষণা অথবা অধ্যাদেশের আইনি ভিত্তি নেই। কেবল সংসদে পাস হওয়ার পরই যেকোনো বিষয়ের আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হলে সংসদ লাগবে। অধ্যাদেশ দিয়ে কোনো আইন প্রণয়ন করা যায় না। কারণ সাময়িক কোনো কার্যসম্পাদনের ক্ষেত্রে অধ্যাদেশ দিয়ে থাকেন সামরিক শাসকরা। দেশে তো এখন কোনো সামরিক শাসক নেই। তা হলে অধ্যাদেশের বিষয়টি আসবে কেন-প্রশ্ন করেন তিনি। গণভোট হচ্ছে কোনো একটি বিষয়ে জনমতের প্রতিফলন, সরকার চাইলে সেই জনমতের বাস্তবায়ন করতে পারে। আবার বাতিলও করতে পারে। সেটারও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই- যোগ করেন বর্ষীয়ান এই আইনজীবী।
প্রায় একই সুরে কথা বলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, জুলাই সনদ নিয়ে যে বিতর্ক চলছে আমি বলবো এটা কু-তর্ক। কারণ অধ্যাদেশ দিয়ে এর সমাধান হবে না। এটা নিয়ে রাজনৈতিক সমাধানে আসতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের অঙ্গীকার এক আর বাস্তবায়ন আরেক। সুতরাং এটা নিয়ে মাতম করার কিছু নেই। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয় আলোচনা করে সমাধানে পৌঁছতে পারে।
৫ই আগস্ট রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। জুলাই সনদ ঘোষণা করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত পর্বের আলোচনা চলছে। এই আলোচনা শেষ হলে জুলাই সনদ ঘোষণা করা হবে। এই সনদ নিয়ে কঠোর অবস্থানের কথা জানান দিচ্ছে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল। ওইদিন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূস গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উদ্যাপন উপলক্ষে জুলাই ঘোষণাপত্র এবং রাতে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, আমরা এই ঘোষণাপত্রে হতাশ এবং জাতিও হতাশ। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ঘোষণাপত্র সংবিধানে স্থান দেয়া দরকার ছিল। ৫ই আগস্ট থেকে এই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন করবে বলে আমরা শুনেছিলাম, কিন্তু এটা কখন থেকে বাস্তবায়ন হবে তার কোনো নির্দেশিকা নেই। পরদিন জুলাই ঘোষণাপত্রের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে সংবাদ সম্মেলন ডাকে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন। তীব্র নিন্দা এবং প্রতিক্রিয়া জানায় হেফাজতে ইসলামও।
কথা হয় এসব সংগঠনের একাধিক নেতার সঙ্গে। তারা বলেন, আইনগত ভিত্তি ছাড়া জুলাই ঘোষণাপত্র মূল্যহীন। নির্বাচন হয়ে গেলে পরবর্তী সরকার জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেবে এরকম গ্যারান্টি নেই। ইতিপূর্বে চারদলীয় জোটের রূপরেখাসহ অতীত অভিজ্ঞতায় তাই বলে। সুতরাং নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগেই জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নচেৎ তাদের আন্দোলনের পথে হাঁটতে হতে পারে। এ ছাড়া জুলাই ঘোষণাপত্রের সংশোধনের কথাও বলছেন কেউ কেউ।
জুলাই ঘোষণাপত্রে একটি নির্দিষ্ট দলের চিন্তা-চেতনা প্রকাশ পেয়েছে বলে রাজনীতির ময়দানে গুঞ্জন উঠেছে মন্তব্য করে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরের ঘটনাসহ অনেক কিছুই জুলাই ঘোষণাপত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। জুলাইয়ের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, তা ঘোষণাপত্রে প্রতিফলিত হয়নি। এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে ঘোষণাপত্রটি সংশোধন করতে হবে।
তিনি বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রে ইসলামপন্থিদের অবদান মূল্যায়িত হয়নি। প্রধান উপদেষ্টার তৈরি ঘোষণাপত্রটি অসম্পূর্ণ। বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে নতুন ফ্যাসিবাদের জন্ম হতে পারে। নির্বাচনের সময় ঘোষণাকে ইতিবাচক বলা হলেও, প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে তা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা হবে। নির্দলীয় সরকারের অধীনেই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে সেই আলোকে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানান তিনি। বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
ওদিকে ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব ও দলের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ’২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান চাওয়া সংস্কার বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। জুলাইয়ের প্রধান দাবি স্বৈরতন্ত্রের পুনরাবৃত্তি রোধকল্পে পরীক্ষিত পদ্ধতি নিম্ন্নকক্ষে পিআর নিয়েও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি; এমনকি এজেন্ডাও তোলা যায়নি। সংস্কারকে এমন অসম্পন্ন ও অনিশ্চিত অবস্থায় রেখে সরকার নির্বাচন আয়োজনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, এই সরকার কোনো নির্বাচনকালীন সরকার না। বরং এই সরকার রাষ্ট্র, সমাজ, প্রশাসন ও রাজনীতি থেকে ৫৪ বছরের জঞ্জাল দূর করার তাকিদ থেকে সৃষ্ট গণ-অভ্যুত্থানের ফলে গঠিত সরকার। নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে, তবে তা হতে হবে জুলাই সনদের ভিত্তিতে। সেই জুলাই সনদের বিষয়ে কোনো সুরাহা না করেই নির্বাচনের যাত্রা জাতির জীবনে জুলাই অভ্যুত্থানের পুনরাবৃত্তিকে অপরিহার্য করে তুলবে।
এর আগে বুধবার সংবাদ সম্মেলন ডেকে ইসলামী আন্দোলনের আমীর মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম (পীর চরমোনাই) অধ্যাদেশ জারি বা গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি তৈরি এবং জুলাই সনদের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানান। দেশের আইনশৃঙ্খলা উন্নতি না হলে আগামী নির্বাচনও কলঙ্কিত হতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে ইসলামী আন্দোলনের আমীর বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি না হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা আমাদের জন্য কঠিন হবে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ২০১৩ সালের শাপলা চত্বর ট্র্যাজেডি ছাড়া চব্বিশের বিপ্লবের পাটাতন তৈরি হতো না। অথচ জুলাই ঘোষণাপত্রে এটাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। তিনি শাপলার রক্তের স্বীকৃতি, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় যুগ্ম- আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক বিষয়ে একমত পোষণ করেছে। তার ওপর ভিত্তি করে জুলাই সনদের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। তবে সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তা নিয়ে যদি কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তাহলে আমরা কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বসবো। জুলাই সনদের খসড়ার প্রক্ষিতে সবগুলো দল তাদের মতামত ঐকমত্য কমিশনের কাছে জমা দিয়েছে। সে মতামতগুলো নিয়ে কমিশন এক্সপার্টদের সঙ্গে বসে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে আমাদের দাবি ছিল ৩৬ জুলাইয়ের মধ্যে দিতে হবে কিন্তু জুলাই সনদ সংস্কারের বিষয় সেক্ষেত্রে সময় ১ মাস বেশি লাগতে পারে। তিনি আরও বলেন, জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়িত হবে তার একটি বিস্তারিত রোডম্যাপ আমাদেরকে দিতে হবে। রোডম্যাপ না পেলে আমরা সনদে স্বাক্ষর করবো না। আমরা আগেও বলেছি জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন না হলে এবং এর আইনি ভিত্তি দেয়া না হলে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো না। এর পরেও আমরা দলীয়ভাবে বৈঠক করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবো।
গণঅধিকার পরিষদের দপ্তর সম্পাদক শাকিল উজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে জুলাই সনদের খসড়া তৈরি করা হয়েছে তা নিয়ে কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সামনে আলোচনায় বসবে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন না হলে গণঅধিকার পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। পাশাপাশি ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন জুলাই সনদে উল্লেখ থাকতে হবে। যদি উল্লেখ করা না হয় তাহলে আমরা সনদে স্বাক্ষর করবো না।
এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। জুলাই সনদের যে সকল বিষয়ে সকল রাজনৈতিক দল একমত পোষণ করেছে, সেগুলো স্বাক্ষরিত হওয়ার পরপরই বাস্তবায়ন শুরু হওয়া দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সুরাহা হওয়া জরুরি। আমরা চাই এই ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দলিল যেন আমাদের জন্য অলংকারিক বস্তু হয়ে না থাকে, সবাই যেন এটা যথাযথভাবে মেনে চলে। নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ ও সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য ফ্যাসিবাদীদের বিচার ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তা নাহলে নির্বাচন নিয়ে সংশয় ও অনিশ্চয়তা কাটবে না বলে মনে করি।
ওদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের তরফে নির্বাচনের একটা রোডম্যাপ ঘোষণার পর কয়েকটি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দাবি করে যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে তার পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও সমমনা দলের পক্ষ থেকে অবশ্য সনদে স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে কোনো শর্ত দেয়া হয়নি।