
থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসা আয়োডিন থেরাপি। সাধারণত সার্জারির পর এ ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের রেডিও আয়োডিনের মাধ্যমে আয়োডিন থেরাপি দেয়া হয়। লিক্যুইড রেডিও আয়োডিন ও আয়োডিন ক্যাপসুলের মাধ্যমে এ থাইরয়েডের চিকিৎসা হলেও দেশে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে রেডিও আয়োডিন ক্যাপসুলের মাধ্যমে চিকিৎসা। প্রায় ছয় মাস ধরে দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার এই অত্যাবশ্যকীয় উপাদান সরবরাহ করতে পারছে না সরকার। সারা দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রেডিও আয়োডিন সরবরাহ করে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। দেশে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের আওতাভুক্ত পরমাণু চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বন্ধ হয়ে আছে আয়োডিন থেরাপি। থাইরয়েড ক্যান্সারের আক্রান্ত রোগীদের সার্জারির পর ছয় মাস ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে সার্জারি করা রোগীদের। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে রেডিও আয়োডিন লিকুইডের মাধ্যমে কোনোভাবে চিকিৎসা চালিয়ে নেয়া হচ্ছে সংকটাপন্ন রোগীদের। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেসের প্রধানরা জানিয়েছেন, খুব সামান্য পরিমাণ রোগীদের লিকুইডের মাধ্যমে চিকিৎসা চালাচ্ছেন তারা। তবে, সরকার জানিয়েছে, চলতি মাসের শেষে বা সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে সরবরাহ পাবে প্রতিষ্ঠানগুলো।
রেডিও আয়োডিন থেরাপির বন্ধ হওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রোগী ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পরিচলকরাও। সারা দেশে ২৩টি পারমাণবিক চিকিৎসাকেন্দ্র পরিচালনা করছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। প্রতিষ্ঠানগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রেডিও আয়োডিন সরবরাহের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে আয়োডিন থেরাপি সেবা। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান প্রধান ক্ষোভ ও প্রকাশ করেছেন পরমাণু শক্তি কমিশনের আয়োডিন ক্যাপসুল সরবরাহের ব্যর্থতা নিয়ে। সারা দেশের ২৩টি নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সেখানে রোগীদের সিরিয়াল জমে যাচ্ছে। চিকিৎসকরা দিতে পারছেন না থেরাপি। তারা বলছেন, তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানের মতো সারা দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই এই থেরাপি বন্ধ রয়েছে। তারা জানান, আয়োডিন ক্যাপসুলের অভাবে খুব সামান্যসংখ্যক রোগীদের তারা লিকুইডের মাধ্যমে চিকিৎসা দিচ্ছেন। এই লিকুইড আয়োডিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে বলে জানিয়েছেন তারা।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সাধারণ দুই প্রক্রিয়ায় থাইরয়েডের চিকিৎসায় আয়োডিন ব্যবহার হয়ে থাকে। একটি হলো-লিকুইড আয়োডিন খাইয়ে, অন্যটি আয়োডিন ক্যাপসুলের মাধ্যমে। সরবরাহ বন্ধ থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে ক্যাপসুলের মাধ্যমে চিকিৎসা। পারমাণবিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত আয়োডিন ক্যাপসুলের মাধ্যমে থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে এটি সরবরাহ না থাকায় বেকায়দায় পড়ে গেছে প্রতিষ্ঠানগুলোও। প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, সপ্তাহে দুই থেকে তিনজন রোগীকে তারা আয়োডিন লিকুইডের মাধ্যমে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারছেন।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক দেশের একটি নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের পরিচালক মানবজমিনকে বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আয়োডিন ক্যাপসুলের মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে না পেরে রোগীদের লিকুইড আয়োডিনের মুখে দিয়ে চিকিৎসা করান। যা অনেক বিপজ্জনক। সাধারণত, লিকুইড আয়োডিন বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং থাইরোটক্সিক রোগীদের জন্য কার্যকর। এটি থাইরয়েড গ্রন্থির ফাংশন কমাতে ব্যবহার হয়। কিন্তু ক্যান্সারের জন্য ক্যাপসুলের মাধ্যমে চিকিৎসা নিরাপদ এবং আন্তর্জাতিকভাবে এটি স্বীকৃত। লিকুইড আয়োডিন মুখে দিয়ে খাওয়ানো হলে সেটি গলাসহ শরীরের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের সংস্পর্শে চলে আসে। ফলে তখন বিভিন্ন বিকিরণের সম্ভাবনা থেকে যায়। তাছাড়া এটি চিকিৎসা দেয়া বিপজ্জনক। অন্যদিকে আয়োডিন ক্যাপসুল মুখে দিলে সরাসরি পাকস্থলিতে চলে যায়। সেখানে গিয়ে ক্যাপসুল খুলে।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবির মানবজমিনকে বলেন, আমরা সাধারণত থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের সার্জারি করাই। সার্জারির পর রোগীদের ছেড়ে দেয়া হয়। আমরা শুনেছি, থেরাপি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। থাইরয়েড ক্যান্সারের রোগীদের জন্য আয়োডিন থেরাপি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটি না দিলে একদমই ফিরে আসতে পারে না, বিষয়টি এমনও না।
ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস চট্টগ্রামের পরিচালক ডা. পবিত্র কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, আমাদের আয়োডিন সরবরাহ বন্ধ নেই। মূলত থাইরয়েড ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য যে রেডিওআইসোটোপ রয়েছে সেটি বন্ধ রয়েছে। তাই মোটামুটি এ বছরের শুরু থেকেই রেডিও আয়োডিন থেরাপি দেয়া যাচ্ছে না। কুমিল্লা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেসের পরিচালক ডা. মুন্সী মো. আরিফ হোসেন বলেন, আনুমানিক ৬ মাস রেডিও আয়োডিন ক্যাপসুলের সরবরাহ নেই। ক্যাপসুল নেই, তাই যাদের অবস্থা বেশি খারাপ, বা যাদের জরুরি দরকার তাদেরকে আমরা লিকুইড ফর্মের আয়োডিন দিচ্ছি এখন। লিকুইডেরও পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। সব রোগীদের লিকুইড সরবরাহ করা যাচ্ছে না। প্রতি ১০ জন রোগীর মধ্যে ২ থেকে ৩ জন রোগীকে এ লিকুইড আয়োডিন দিয়ে সেবা দেয়া যাচ্ছে। এ কারণে অনেক রোগী বেড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ তাদের থেরাপি নেয়ার সময় বেড়ে যাচ্ছে। মহাখালীতে অবস্থিত ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেসের পরিচালক ডা. শারমিন কুদ্দুস বলেন, আমরা ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য বিদেশ থেকে আসা আয়োডিন ক্যাপসুলের সরবরাহ পাচ্ছি না। তাই আয়োডিন থেরাপি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না এখন। তবে আমাদের কাছে থাকা লিকুইড আয়োডিন দিয়ে আপাতত দিতে পারছি। তাও সবাইকে না। লো-ডোজ দিলে হবে এমন রোগীদের এটি দেয়া যাচ্ছে। আর যেখানে হাই-ডোজ লাগে, সেখানে লিকুইড দেয়া বিপজ্জনক। রোগীদের আমরা এখন থাইক্সিন ওষুধ দিয়ে রাখছি। যা সাধারণত থেরাপি দেয়ার পরে দেয়া হয়। যাতে করে ক্যান্সার কোষ না ছড়ায়। এর মাধ্যমে আপাতত রোগীদের একটু কম রিস্কে রাখছি।
চিকিৎসা অভিজ্ঞতা নিয়ে একজন সাংবাদিক সম্প্রতি ফেসবুকে লিখেন, ২০১১ সালে নাজ-ই-নুর নামক এক হাসপাতালে রেডিও আয়োডিন থেরাপি নিয়ে পাঁচ দিন কোয়ারেন্টারাইন-এ ছিলাম। কোনো থাইরয়েড ক্যান্সার রোগী অপারেশনের পর এই রেডিও অ্যাক্টিভ আয়োডিন থেরাপি ছাড়া বাঁচতে পারবে না। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় গত ছয় মাস যাবত থাইরয়েড ক্যান্সারের রোগীরা কোনো রেডিও আয়োডিন থেরাপি পাচ্ছে না। কারণ দেশে কোনো রেডিও আইসোটোপ নাই। এই চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রাইভেট সেক্টরও নাই আমাদের দেশে। তিনি লিখেন, থাইরয়েড ক্যান্সার রোগীদের সার্জারি পরবর্তী চিকিৎসা রেডিও আয়োডিন থেরাপি। এই চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত পরমাণু চিকিৎসাকেন্দ্র। ব্যাপারটা খুবই মানবিক, ক্যান্সার রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছে না তাদের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও একটা ভালো সার্জারি হওয়ার পর।
জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নেয়া একজন রোগী জানান, জরুরি এই থেরাপি নিতে পারছি না। এখন পরিস্থিতি খারাপ হয় কিনা এ নিয়ে আতঙ্কে আছি।
এ বিষয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ পারমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মো. কামরুল হুদার সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিক বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোকাব্বির হোসেন মানবজমিনকে বলেন, আমি পারমাণু শক্তি কমিশন ও ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের সেখানে চিকিৎসার জন্য ক্যাপসুল আমদানি করতে না পারায় এর বিকল্প হিসেবে লিকুইড আয়োডিন ব্যবহার করে কাজ চালাচ্ছেন। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন জানিয়েছে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে বা এই মাসের শেষের দিকে এটি নিয়ে আসবে। চিকিৎসকরা বলেছেন, লিকুইড ব্যবহারের ক্ষেত্রে কী পরিমাণ লিকুইড ব্যবহার করবেন এটা তারা ঠিক করেন। তারা বলেছেন, লিকুইড এবং ক্যাপসুলের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। আমদানি বন্ধ থাকার কারণ, আগে পরমাণু শক্তি কমিশন পোল্যান্ড থেকে ক্যাপসুল আমদানি করতো। কিন্তু তাদের সাপ্লায়ারের সঙ্গে চুক্তি শেষ হওয়ার পর নতুন সাপ্লায়ারের সঙ্গে টেন্ডার করে নিয়েছিল। মিশরের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করা হচ্ছে। তাছাড়া অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য কিছু সরাসরি প্রসেসিং করা হচ্ছে। যেগুলো আসার কথা এ মাসের শেষে বা আগামী মাসের শুরুতে। আবার চিকিৎসা হয় না এ বিষয়টিও সঠিক নয়।
প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে বলেন, রেডিও আয়োডিন সরবরাহের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে পরমাণু শক্তি কমিশন। তবে সেন্টার শুধু আমাদের হাসপাতাল ক্যাম্পাসে হয়। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।