
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় বৃটিশ শাসনামলের এক ঐতিহাসিক নিদর্শন শ্রী লক্ষ্মীচরণ সাহার ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ি। জমিদারির বিত্ত-বৈভব প্রদর্শনের জন্য নির্মিত এই বাড়ি বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকলেও সেই অতীত জৌলুস আর নেই।
জমিদারি ইতিহাস, ঐতিহ্য, শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহার সামাদি আর স্থাপত্যে ঐতিহ্যে অতুলনীয়তার কারণে বর্তমানে এই জমিদারি বাড়ি ভ্রমণ পিপাঁসুদের কাছে দিন দিন আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠলেও প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাওয়ার পথে এই ঐতিহাসিক নিদর্শন। বাস কিংবা সিএনজি বেবী টেক্সীযোগে চট্টগ্রাম শহর হতে প্রায় ১২ কিলোমিটার দুরে হাটহাজারী উপজেলার নন্দীর হাট বাজারে নেমে পশ্চিম দিকের সড়ক ধরে ১ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই বাড়িটির দেখা মিলে।
প্রায় ৫ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত দ্বিতল ভবনটির দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ খচিত দেয়াল, মাথা উচু করে দাড়িয়ে থাকা স্তম্ভ আর কার্ণিশের বাহার দেখে দুর থেকে বোঝার উপায় নেই এ বাড়ির জরাজীর্ণ ও ভঙ্গুর দশা।
জানা যায়, ১৮৯০ সালে জমিদার লক্ষীচরণ সাহা জমিদারির প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রদর্শনের জন্য এই দ্বিতল বাড়িটি নির্মাণ করেন। বাংলা চলচ্চিত্রেও রয়েছে এই জমিদার বাড়ির বিচরণ। ১৯৭৫ সালে এই জমিদার বাড়ির সন্তান প্রযোজক সত্য সাহার প্রযোজনায় নির্মিত “অশিক্ষিত ”ছবির শ্যুটিং করতে এই বাড়িতে ১৭ দিন অবস্থান করেছিলেন খ্যাতিমান চলচ্চিত্র অভিনেতা রাজ্জাক, নায়িকা অঞ্জনা সহ ছবির কলাকৌশলীরা। এছাড়া ১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা চলচ্চিত্র “ছুুটির ঘন্টা” ছবির বেশ কিছু দৃশ্য ধারণ করা হয় এ বাড়ি থেকে। বর্তমানে বাড়িটির চারপাশ ঘুরে দেখা যায়, বাড়িটিতে দৃষ্টিনন্দন শান বাঁধানো পুকুর ঘাট আর পূজা মন্ডপ অস্তিত্বশূন্য হতে চললেও একেবারে বিলীন হয়ে গেছে সেরেস্তা ঘর, ধানের গোলা, রান্নাঘর আর নাচঘর। বর্তমানে জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বাড়িটিতে বসবাস করছেন লক্ষ্মীচরণ সাহার বংশদরেরা।
এই বাড়িতে বসবাসকারী লক্ষ্মীচরণ সাহার বংশদর স্বপন কুমার সাহা জানান এই বাড়ির সম্বৃদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা। ১৯২০ সালে জমিদার লক্ষী চরণ সাহা, মাগল সাহা ও নিশি কান্ত সাহা এই তিন ভাইয়ের হাত ধরে জমিদারি প্রথা শুরু হয়েছিল এ অঞ্চলে। হাটহাজারী উপজেলার নাজিরহাট, ধলই, গুমানমর্দ্দন, চারিয়া, জোবরা, আলীপুর, ফতেয়াবাদ সহ বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল তাদের জমিদারী। এইসব অঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার কৃষক প্রতিবছর খাজনা দিতে আসত এই বাড়িতে। নিয়মিত রাজ পূণ্যাহ অনুষ্ঠান হতো। চাকর-বাকর ছিল অর্ধশতাধিক, ছিল নয় জোড়া হালের গরু, গোলা ভরা ধান আর পুুকুর ভরা মাছ। একেক বেলায় রান্না হত প্রায় দু-তিনশ লোকের। কিন্তু কালের বিবর্তনে লক্ষী চরণ সাহার বড় ছেলে প্রসন্ন কুমার সাহার হাতে ধরে এই বিস্তৃত জমিদারির ইতি ঘটে।
বর্তমানে অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে থাকা এই বাড়ি ইতিহাস-ঐতিহ্য বিবেচনায় হতে পারে পুরাকীর্তি বিভাগের এক অমূল্য সম্পদ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট বাংলার ইতিহাসকে তুলে ধরতে এই ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন এলাকাবাসী।