
জুলাই সনদের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা ও বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণে আগামী সপ্তাহ থেকে আবারও আলোচনা শুরু করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। শুক্রবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে ঐকমত্য কমিশনের সংবাদ সম্মেলনে একথা জানান কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নের অগ্রগতি তুলে ধরতে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
আলী রীয়াজ বলেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে রচিত ও স্বাক্ষরিত সনদের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করাসহ এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি কী হবে, তা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা দরকার। সে লক্ষ্যে কমিশন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আগামী সপ্তাহে আলোচনা করবে। ওই আলোচনার আলোকেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরবর্তী পর্যায়ের আলোচনায় বসবে কমিশন। আশা করা যায়, এই প্রক্রিয়ায় স্বল্প সময়ের মধ্যেই উপযুক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গত দুই পর্বের আলোচনায় জাতীয় সনদ প্রণয়নের লক্ষ্যে তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যক সুপারিশ বা সংস্কারের ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য সম্ভব হয়েছে। তিনি জানান, ২৮ জুলাই পাঠানো সনদের খসড়ার জবাব দিয়েছে দলগুলো। আশা করি, সে আলোকেই একটি ঐকমত্যে পৌঁছা সম্ভব হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে টেকসই গণতন্ত্র।
অনেকে জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দাবি করছেন। কমিশন এ নিয়ে কী ভাবছে-এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, নির্বাচন কীভাবে হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সরকার নির্বাচনের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করবে। আমাদের কাজ একটি জাতীয় সনদ করে দেওয়া।
নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে যেসব সিদ্ধান্তে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোর ভবিষ্যৎ কী- টিআইবির এ সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, টিআইবির বিষয়ে আমরা সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারব না। তবে এ প্রক্রিয়াকে সামনে রেখে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছতে চেয়েছি। বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমাদের নয়। তারপরও আমরা আরও আলোচনা করতে চাই।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিগত ১৪-১৫ বছরে আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। তাই এবার সব নাগরিক নির্বাচিত প্রতিনিধি চান। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কমিশনের পরিচালন ব্যয় সম্পর্কে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আমরা নিজস্ব কোনো ব্যয় করি না। এটি দেখার দায়িত্ব সংসদ সচিবালয়ের।
সরকারের পক্ষে নিশ্চয়ই অডিট হবে।
১১ বিষয়ে সব দলের সমর্থন, নয়টিতে নোট অব ডিসেন্ট : সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রথম পর্বের আলোচনায় ১৬৫টি প্রস্তাবের মধ্যে ৬২টিতে রাজনৈতিক ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে। সরকার যার কিছু কিছু এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করেছে। দ্বিতীয় পর্বের সংলাপে গুরুত্বপূর্ণ ২০টি সাংবিধানিক বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে ১১টি বিষয়ে সব দলের সমর্থনে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভিন্নমত ছাড়া গৃহীত প্রস্তাগুলো হচ্ছে-(১) সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি; (২) নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ; (৩) রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান; (৪) বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ-(ক) সুপ্রিমকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ, (খ) উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্র্রসারণ; (৫) জরুরি অবস্থা ঘোষণা; (৬) প্রধান বিচারপতি নিয়োগ; (৭) সংবিধান সংশোধন; (৮) প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল; (৯) নির্বাচন কমিশন গঠন; (১০) পুলিশ কমিশন গঠন; (১১) নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ-সম্পর্কিত প্রস্তাব। এছাড়া বাকি ৯টি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্টসহ (ভিন্নমত) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নোট অব ডিসেন্টসহ গৃহীত প্রস্তাবগুলো হচ্ছে-(১) সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০ সংশোধন; (২) প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান; (৩) সরকারি কর্মকমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সম্পর্কিত [ইতঃপূর্বে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের বাছাই কমিটি নামে প্রস্তাবিত ছিল (যা পূর্বে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ বা ‘এনসিসি’ নামে প্রস্তাবিত ছিল)]; (৪) সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব (সংখ্যা বৃদ্ধি, নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদি); (৫) দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট (উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার ইত্যাদি); (৬) রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি; (৭) তত্ত্বাবধায়ক সরকার; (৮) রাষ্ট্রের মূলনীতি; (৯) রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]। তবে এসব প্রস্তাবে কোন কোন দলের ভিন্নমত রয়েছে সনদে তার উল্লেখ থাকবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
প্রসঙ্গত, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাজ শুরু করে। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদনের ছাপানো কপি সব রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়।
এরপর ৫ মার্চ পুলিশ সংস্কার কমিশন বাদে পাঁচটি কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ স্প্রেডশিট আকারে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে মতামতের জন্য পাঠানো হয়। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক ৭০টি, নির্বাচন সংস্কার বিষয়ক ২৭টি, বিচার বিভাগসংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসনসংক্রান্ত ২৬টি ও দুর্নীতি দমন কমিশনবিষয়ক ২৭টি সুপারিশ ছিল। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো সরাসরি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়নযোগ্য হওয়ায় সেগুলো স্প্রেডশিটে রাখা হয়নি। সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া অন্য পাঁচটি কমিশনের দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোর তালিকা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
প্রথম পর্বে ঐকমত্যে ৬২টি বিষয়ে, দ্বিতীয় পর্বে ২০টিতে : মোট ৩৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট তাদের মতামত কমিশনের কাছে পাঠায়। অনেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও দেয়। মতামত গ্রহণের পাশাপাশি প্রথম পর্যায়ে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৩২টি দল ও জোটের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মোট ৪৪টি বৈঠক হয়। কিছু দলের সঙ্গে হয় একাধিক বৈঠক। প্রথম পর্বের আলোচনায় ৬২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়। কুরবানির ঈদের আগে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা সংসদ ভবনের এলডি হলে শেষ হয়।
এরপর ২ জুন দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা উদ্বোধন করে কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ করে কমিশন অগ্রাধিকার ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় ২০টি বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলোচনা করে। আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ৩ জুন থেকে। চলে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ২৩ দিন। এবার তৃতীয় পর্বে আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছে কমিশন। তৃতীয় পর্বে জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণে বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবেন তারা। এরপর সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর সই নেওয়া হবে। এর মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে জুলাই জাতীয় সনদ।